বুক রিভিউ-১

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

বুক রিভিউ : “শিকড়ের সন্ধানে”
লেখিকা : হামিদা মুবাশ্বেরা
লিখেছেন- তানজিনা রহমান

১৪০০ বছর আগে যে বইটির আয়াত শুনে কাফের মুশরিকদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে, মন হয়েছে আল্লাহ ভীরু; সেই বইটিকে আজকে আমরা সম্মানের উচ্চশিখরে তুলে বুক শেলফের সব চেয়ে উঁচু তাকে সাজিয়ে রেখেছি | অথচ জন্মগত ভাবে মুসলিম পরিচয় ধারী হয়েও কেন এই মুজিজায় ঠাসা কুরআন এক বারও মনে গভীর দাগ কাটেনি সেই প্রশ্ন নিজেকে করতে গিয়ে দেখি আমিও অনেকের মতোই দ্বিতীয় সূরা বাকারায় এসে থেমে গেছি, confused হয়েছি আল্লাহ তা’লা যখন বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন ঘটনার রেফারেন্স টেনে এনে দিশেহারা আমাকে বোঝাচ্ছেন |

আরবি না জানা এবং এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে ধারণা না থাকাই এই বিরাট সমস্যার হেতু | এই সময় আলোকবর্তিকার মতো বোন হামিদা মুবাশ্বেরা একটি ফেসবুক সিরিজ লেখা শুরু করেন। | সাবলীল ভাষায় কঠিন বিষয়গুলো অবলীলায় বলে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ আপু টির সিরিজটি নিয়ে নড়ে চড়ে বসলাম আর অবাক বিস্ময়ে গলধঃকরণ করলাম কুরআনের ঘটনা প্রবাহ এবং সমসময়িক বিভিন্ন সমস্যার আল্লাহ প্রদত্ত সমাধান | যা বিশেষ ভাবে কুরআনকে নিয়ে, এর প্রতিটা আয়াতকে নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে | ফলশ্রুতিতে, কুরআনের অনুবাদ পড়াটা হয়েছে আনন্দ দায়ক ও সুখপাঠ্য |

সিরিজটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে প্রতি পর্বের শেষে আমরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতাম পরবর্তী পর্বের জন্য | অনেকেই সব পর্বগুলো একত্রে এক মলাট বদ্ধ ভাবে পেতে চাইলেন | কারণ, এটি যেমন আমাদের মুসলিম হিসেবে স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সচেতন করেছে তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তৈরী করেছে | তাই কয়েক বছরের ব্যবধানে যখন সিরিজটি বই আকারে হাতে পেলাম তখন মন থেকে বলেছি আলহামদুলিল্লাহ!

নতুন উদ্দামে পড়ে ফেললাম এ মলাট থেকে ও মলাট | রিভিউ করতে গিয়ে বইটির যে বৈশিষ্ট্য গুলো মন ছুঁয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ না বললেই নয় –

১. কঠিন বিষয় সহজ করে বলার মুন্সিয়ানা তারাই দেখতে পারে যাদের বিষয়টি সম্পর্কে রয়েছে অগাধ ধারণা | বইটির প্রতিটা পরতে পরতে রয়েছে সুগভীর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা এবং ইসলামিক দলিল ভিত্তিক কথন | যা পাঠককে শুধু ইসলাম সম্পর্কিত হাতেখড়িই দেয়নি, আল্লাহর আয়াত গলো নিয়ে কিভাবে ভাবতে হয় তা ও শিখিয়েছে, জন্ম দিয়েছে যুক্তি বাদী মন |

২. ক্রমান্বয়ে ইতিহাসের দলিল এবং যুক্তির ওপর দাঁড় করানো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নবীদের (বিশেষত মুসা (আ) এর জীবনের ঘটনা প্রবাহ) জীবনী নিয়ে আল্লাহ আমাদেরকেই কি বলতে চাইছেন তার প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে বইটিতে | সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টি হলো, মুসা (আ) সহ অন্যান্য নবীদের এর জীবনী থেকে যে শিক্ষা আল্লাহ তা’লা আমাদের দিয়েছেন তা নবীজি (সা) কি করে তাঁর সময় কালে আরোপ করেছেন তার সাথে লেখিকা আমাদের পরিচয় করিয়েছেন | যেন অনুরূপ প্রেক্ষাপটে আমরা এই শিক্ষা থেকে আমাদের করণীয় নিয়ে confused না হই |

৩. আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’লা কোনো জাতিকে যখন তাঁর দিকে ডাকেন তখন তাদের আলোক বর্তিকা স্বরূপ পাঠিয়েছেন নবীদের | তারা যেন সহজেই ঈমান আনতে পারে তাই সেসব নবীদের দিয়েছেন অলৌকিক মুজিজা | যেমন মুসা (আ) কে দিয়েছেন সাগর ফেরে পথ তৈরির সক্ষমতা, সুলায়মান (আ) কে দিয়েছেন জ্বীন জাতির উপর কর্তৃত্ব, ঈসা (আ) দিয়েছেন মৃতকে জীবিত করার মুজিজা | কিন্তু, সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা) কে দিয়েছেন একটি বই | যার পরতে পরতে রয়েছে ভাষাগত অলৌকিক মুজিজা যা আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের জন্য সংরক্ষণ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন | আরবি না জানার কারণে এই স্বর্গীয় সুধা থেকে আমরা যারা বঞ্চিত, লেখিকা তার বইটিতে এর কিছু দিক চমকপ্রদভাবে উল্লেখ করেছেন |

৪. নবীদের জীবনী বর্ণনা কালে এক নবীর সাথে আরেক নবীর সম্পৃক্ততা কিভাবে ছিল তার অনেক খানি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেলেও মিসিং লিংক হিসেবে লেখিকা দালিলিক প্রমাণ দিয়ে তা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেছেন যা পাঠককে দেবে চরম রোমাঞ্চ |

৫. সর্বোপরি, ইব্রাহিম (আ) এর প্রকৃত অনুসারী হিসেবে দাবি করা মানুষ গুলো আজকে কিভাবে ইহুদি, খ্রিসটান ও মুসলিম এই তিন পরিচয়ে বিভক্ত এবং কারা এখনো ঘটনা পরিক্রমায় সত্য পথে রয়েছে সেই ইতিহাস প্ৰাঞ্জলভাবে ফুটে এসেছে বই টিতে |

আমরা যদি নিজের পরিচয় সম্পর্কে জানি , জানি আমাদের আলোকিত স্বর্ণ যুগের ইতিহাস আর আমাদের স্বাতন্ত্র্য, তাহলে আপনা আপনি আমরা বুঝে যাবো আমাদের জীবনের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে, আবিষ্ট হবো নিজ লক্ষ্যে, খুঁজে পাবো জীবনের উদ্দেশ্য | লেখিকাকে অজস্র ধন্যবাদ কান্ডারিবিহীন এই প্রজন্মকে এমন একটি দিশারী দিয়ে সাহায্য করার জন্য | আল্লাহ তা’লা উনাকে ইসলামের বৃহৎ কল্যাণে নিয়োজিত করে আমাদের উপকার করার তৌফিক দিন |


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন