১.
সেই ভোর রাত থেকে ময়মনসিংহ বাস স্ট্যান্ডে বসে আছে শোভা। কাল থেকে গার্মেন্টস খোলা। আজ ভোর ভোর রওয়ানা করে যদি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জ, সে আশায় একটু আগেই বের হয়েছে বাড়ি থেকে।
বাড়ির কথা ভাবতেই অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে!! বাড়িতে কি করছে দেড় বছরের মেয়েটা? মেয়েটার মুখে বোল ফুটেছে মাস দুয়েক হয়। মেয়ে ঘুম থেকে উঠে শোভাকে দেখলে আর ছাড়তে চাইবে না। তড়িঘড়ি করে চলে আসার এটাও একটা কারণ।
মেয়ের আট মাস বয়সেই নিজের বৃদ্ধা মা আর বৃদ্ধ বাবার কাছে রেখে শহরে পা বাড়িয়েছিল শোভা। বিয়ের আগেও এই গার্মেন্টসেই চাকরি করতো। আগের ঘরের কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে শোভাকে ঘরে তুলেছিল তার স্বামী। বিয়ের বছর না ঘুরতেই সন্তান সম্ভবা শোভার কোল জুড়ে মেয়ে সন্তান আসার অপরাধে স্বামী নামের বস্তুটি তিন তালাক ঘোষণা করে পরবর্তী স্ত্রী যোগাড় করার মিশনে বেরিয়েছে।
সেই থেকে সংসারের জোয়াল উনিশ বছর বয়সী শোভার ঘাড়েই। গত দশটি মাস ঘাড় গুঁজে কেবল কাজ করেছে শোভা। মেয়ের জন্য দুধ, নিজের থাকা খাওয়া,বাবা মায়ের থাকা খাওয়া, সব এসে চেপেছে মেয়েটার কাঁধে। দশ মাস পর নিজের মেয়েকে দেখার সুযোগ এলো করোনার কারণে। কি এক অদ্ভুত অসুখ এসেছে দেশে, সবাই খুব কথা বলছে এই নিয়ে। হঠাৎ করেই গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেল। রোজার ঈদের আগে অপ্রত্রাশিত ছুটি পেয়ে তাই আর আগ পিছ না ভেবে বাড়ি চলে গেছিলো শোভা।
মার্চ মাসের বেতন হাতে আসেনি। জমানো সাতশো টাকা নিয়ে মেয়েটার টানে চলে এসেছে বাড়ি। যদিও সবাই বলাবলি করছিল করোনা রোগটা নাকি অনেক ছেঁায়াচে, এভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি ফেরাটা নাকি ঠিক হচ্ছে না, তবে মায়ের মন এত কিছু বুঝতে চায় না। করোনার উসিলায় ছুটি পেয়ে নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে তো কোলে নেয়া গেলো! বুক তো জুড়ালো!
এক সপ্তাহ পার হয়ে যেতেই এই সুখ আর রইলো না। মোবাইলে মেসেজ আসলো ছুটি শেষে কারখানায় যোগ না দিলে গত মাসের বেতন তো পাবেই না বরং চাকরীও চলে যেতে পারে। এই মেসেজ পেয়েই পরদিন ভোরে রওনা দিয়েছে শোভা।
বাজারে জিনিসপাতির দাম বাড়তি। চারটি মুখের প্রতি বেলার খাবার জুটানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বেতন না পেলে,চাকরি চলে গেলে ভবিষ্যতে কি হবে এসব ভেবে রীতিমত ঘাম ছুটছে শোভার।
অইদিকে কোনো বাসের নিশানাও নাই রাস্তায়। সকাল হবার সাথে সাথে আরো লোকজন জড়ো হছে বাসস্ট্যান্ডে। এতো মানুষ যাবে কিভাবে! এরমধ্যে পুলিশ এসে হাজির। জানা গেলো বাসের ব্যবস্থা হবে না। বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যে করেই হোক ঢাকা পৌঁছতে হবে। গাড়ি ভাড়ার জন্য পাঁচশো টাকা মা ধার করে এনে দিয়েছে পাশের বাড়ির খালাম্মার কাছ থেকে। বেতন পেয়ে টাকাটা শোধ করতে হবে। এর মধ্যে একটা পিকআপ আসলো খালি, শ্রীপুর অব্দি যাবে। উপায়ন্তর না দেখে সবাই তাতেই উঠে পড়লো। কিন্তু শ্রীপুর অব্দি যাওয়া হলো না। আমতলী আসতেই পুলিশের পিটুনির মুখে পিকাপ থেকে নেমে যেতো হলো সবাইকে। অগত্যা সবাই পায়ে হেঁটে রওনা দিল। শোভাও ঢলের সাথে হাটতে লাগলো। দুপুরের ঠা ঠা রোড শরীরের সব চুঁষে নিয়ে নিচ্ছে যেনো।
পাঁচ ঘণ্টা টানা হাটার পর ভাওয়াল এসে ঠেকলো মানুষের ঢল। আর হাঁটা সম্ভব হচ্ছেনা। এখান থেকে আটোরিক্সা যাচ্ছে গাজীপুর অব্দি। অটোরিক্সায় চেপে গাজীপুর এলো। কেউ কেউ এবার একটু পানি আর বিস্কুট মুখে দিচ্ছে। শোভার অতো সময় কই! নারায়ণগঞ্জ ফিরে একবারে খাবে ভেবে নেয় সে। এমনিতেই যাচ্ছেতাই খরচ হচ্ছে এটায় ওটায় উঠে। সে বাকিপথ কিভাবে যাবে উপায় খুজতে থাকে। এরমধ্যে লোকাল সিএনজি ম্যানেজ করলো কারা যেনো কথা বলে। সেই সিএনজি করে ঢাকায় পৌছালো শোভা। এখানেও সেই পুলিশের দাপট। পায়ে হাটা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে, কিছু পথ রিক্সায় করে নারায়ণগঞ্জ যখন পৌছুলো,তখন এশার আজান হচ্ছে।
মেসে পৌঁছানার পরই শুনলো , গার্মেন্টেস এর ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে । কাল বেতন পাওয়া যাবে না। এদিকে মেসের মালিক এসে বলে গেলো, গ্রাম থেকে ফেরা কাউকেই মেসে উঠতে দেওয়া হবে না। কার সাথে ভাইরাস আছে তাতো আর জানে না কেউ।
অসহায় শোভা মেসের সামনের রাস্তাতেই বসে পড়লো। নিজেকে আর বহন শক্তি নেই তার। পা দুটোর জায়গায় জায়গায় ফোস্কা পড়েছে আর গিটে গিটে ব্যাথা । হাতের মুঠো খুলে অবিশিষ্ট একশো টাকার দলা পাকানো নোটটা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিল শোভা , অশ্রুসজল চোখে আকাশপানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে লাগতে লাগল, “সন্তানের মুখে দুইডা খাবার তুইলা দেওনের লাইগা, বাপ-মায়ের ওষুধ কিইন্যা দেওনের লাইগা যে চাকরী করি সেই চাকরি চইলা যাওনের ভয় দেখাইয়্যা আজ সারাদিন যে আমারে কষ্ট দিল তারে তুমি ক্ষমা কইরো না আ্ল্লাহ।”
২.
রওশন আরার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল বেয়ে পড়ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আরেকবার শোভনের বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। গত কয়েকবার কল কেটে দিয়েছেন রফিকউদ্দিন সাহেব। রওশন আরা তবুও বারবার কল দিয়েই যাচ্ছে দেখে রাগটা আর সামলে রাখা গেলো না। রিসিভ করে চাপা গলায় ইচ্ছেমত ঝাড়লেন বোকার হদ্দ মহিলাকে “বাড়ি বসে নিত্যনতুন রেসিপি ট্রাই করা, ইচ্ছেমত শপিং করা আর বছর বছর বিদেশ যাওয়ার টাকাটা তো আর তোমার রোজগার করতে হয় না,তুমি কি বুঝবে আমার অবস্থা!! বায়াররা অধিকাংশ অর্ডার ক্যান্সেল করে দিচ্ছে অথচ শ্রমিকদের বেতন, ফ্যাক্টরির খরচ ম্যানেজ করতে হবে, অর্ডার যাও আছে তা কমপ্লিট করার জন্য গার্মেন্টস খোলা রাখতে চাইলাম কিন্তু মিডিয়ার চাপে সেটাও সম্ভব হলো না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো রেসপন্স নেই ,অইদিকে অজাতকুজাত শ্রমিকগুলা বেতনের দাবীতে চিৎকার করছে গার্মেন্টসের সামনে দাঁড়িয়ে। এসব তো তোমাকে সামাল দিতে হয় না,তোমাকে এসব বলেও বা কি লাভ! তুমি তো ফোনের পর ফোন দিয়েই যাচ্ছো!! তোমার আক্কেলের বলিহারি!”
রওশন আরা নিচু গলায় বললেন “শোভন তোমাকে সকাল থেকে ফোনে পাচ্ছে না। লিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। কোনো হসপিটাল ওকে ভর্তি নেয়নি। ওর বাচ্চা দুটোরও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সরকার থেকে লোক এসে লক ডাউন করে গেছে গোটা এলাকা। শোভন আর ওর বউ আটকে গেছে ওখানেই। শোভন কিছুক্ষণ আগে বললো ওরও জ্বর এসেছে। আমার ছেলেমেয়ে দুটো ওদের স্বামী স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে বিনে চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, আর তুমি এই অবস্থায়ও তোমার ব্যবসা নিয়ে কথা বলছো। এসব আসলেই আমি বুঝবো না”।
১৮ ডিগ্রীতে দেয়া এসির মধ্যে বসেও রফিকউদ্দিন ঘামতে শুরু করলেন। হ্যাচকা টানে টাইয়ের নট ঢিলা করলেন। গার্মেন্টস নিয়ে এতক্ষণের দুশ্চিন্তা উবে গিয়ে হঠাৎ করে মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। নিশ্চিন্ত, নিরাপদ জীবনের আশায় নিজের সন্তানদের বিদেশে পড়ালেখা করিয়েছেন, ওখানেই সেটল হওয়ার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেও কার্পণ্য করেননি। আজ যদি পৃথিবীর সর্বোন্নত দেশে থেকেও ওরা বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তবে কি হবে তার এই গার্মেন্টস ,বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে?সকাল বেলা শোনা একটা শ্রমিকের গলার আওয়াজ প্রতিধ্বনির মতো বারবার অণুরণিত হতে লাগল তার কানের মধ্যে– “তগোর সন্তান নাই? তাগরে বিনা ভাতে,বিনা চিকিস্সায় মরতে দিবি তরা? তয় আমরার গরীবের পাওনা টাকা কেন দিতে চাস না, কথায় কথায় চাকরী খাওনের ভয় দেখাস?”
এদিকে ফোনটা হাতে নিয়ে সুইমিংপুলের কাছটায় এসে দাঁড়ালেন রওশন আরা। উলটো ঘুরে নিজের আলিশান ডুপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে আবার হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। কে জানতো, অই সব ভালোর দেশে আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা স্বত্বেও ধুঁকে মরতে হবে তার সন্তানদের!
আজ সকালে ইউটিউবে শোনা একজন শায়খের একটা কথা মনে পড়লো রওশন আরার। শায়খ বলছিলেন, “রিজিক মানে তো কেবল প্রতি বেলার খাদ্য কিংবা অর্থ নয়। রিজিক হচ্ছে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়। আর মানুষ ততোটুকু রিজিকই ভোগ করতে পারে যা তার তাকদীরে আছে। অনেক দূরের পাহাড়ে থাকা রিজিকও যেমন ঠিকই ভোগ করা যায় যদি তা তাকদীরে থাকে তেমনি চোখের সামনে থকা রিজিকও ভোগ না করে চলে যেতে হতে পারে যদি তাকদীরে লেখা না থাকে। তাই নিজের রিজিক নিশ্চিত করার প্রলোভনে পড়ে যেন অন্যের হক নষ্ট না করি, অন্যের দীর্ঘশ্বাসের কারণ না হই। আমরা যেন ভুলে না যাই মজলুমের দুআ আর স্রষ্টার মাঝে কোনো আড়াল থাকে না। তিনি তো সবারই রিজিকদাতা,সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক!!