অনুতাপ

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

১.


ঘুমঘুম চোখ মেলে চাইতেই ট্রে হাতে আরিফকে রুমে ঢুকতে দেখলো সায়মা। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে আৎকে উঠে বললো-“সরি !কখন যে এত বেলা হয়ে গেছে, টেরই পাইনি”!
“তাতে কী!আজ আমিই নাস্তা বানিয়ে এনেছি,দেখো!” দু’গাল প্রশস্ত করে বিশ্বজয়ের হাসি হেসে বললো আরিফ।
সায়মাকে ঘুমোতে দেখে সকাল সকাল নিজেই পরোটা, সবজি ভাজি আর গরম চা করে নিয়ে এসেছে। সায়মা ফ্রেশ হয়ে এলে দু’জন নাস্তা করতে বসলো।আরিফ রান্নাবান্নায় তেমন পটু নয়।তবু আজ তার রান্নার প্রশংসা না করলে পারলো না সায়মা।
খেতে খেতেই বললো, “বাহ!বেশ মজা হয়েছে তো! পরোটা-সবজি একদম পারফেক্ট।”
আরিফ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,“সত্যি! ভালো লেগেছে? এখন থেকে কিন্তু ইউটিউব দেখে নতুন নতুন রেসিপি বানিয়ে তোমাকে খাওয়াবো।খাদেমা খালা নেই,আমিও যেহেতু ঘরে আছি ,তোমাকে হেল্প করবো।”
“বাব্বাহ! এতো ভালো হলে কবে থেকে? “ফোঁড়ন কাটল সায়মা।
আরিফ হেসে বললো, “ঘরের কাজে সাহায্য করা নবীজীর সুন্নাহ। সুন্নাহ পালন করব। আর ডাক্তার তো বলেছেই,তোমাকে কিছু দিন বেড রেস্ট নিতে! তাই আমি থাকতে কোন প্যারা নিও না!

আরিফের কথা শুনে ভালো লাগে সায়মার। তার এতদিনের ক্ষোভ ছিল আরিফ ঘরের কোন কাজে হাত লাগায় না। এ নিয়ে দুজনের মনোমালিন্যও কম হতো না। আজ সে নিজে থেকেই এসব কথা বলায় সায়মা খুব খুশি হল।

২.


নাস্তা শেষে এঁটো প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই সায়মার প্রফুল্ল মন নিমিষেই বিষিয়ে গেলো! সামান্ এটুকু কাজ করতে যেয়ে আরিফ যেন রান্নাঘরের সেটআপ টাই চেইঞ্জ করে ফেলেছে! মেঝেতে আটার গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে,সবজির ছোকলা যেখানে সেখানে পড়ে আছে,মসলার বৈয়ামগুলো ওলট-পালট করে রাখা ,মিটসেফের এক একটা তাকে গুছিয়ে রাখা জিনিস সব এলোমেলো! চেঁচিয়ে আরিফকে ডাকতে যেয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলো সায়মা। বেচারা এত শখ করে করেছে..ভেবে শান্ত হয়ে সব পরিষ্কার করা শুরু করলো সে।

৩.


মাছওয়ালার আওয়াজ পেয়ে আরিফ সায়মাকে ভীতকণ্ঠে বললো, “বউ,আধা কেজি ছোট মাছ নিয়ে আসি?”
সায়মা তেড়ে উঠে ,“পাগল! এসব কুটবে কে ? আমার শরীরটাও খারাপ লাগছে! –
“আররে! আমি আছি তো ,টেনশন নাও কেন? নিয়ে আসি, প্লিজ? _
“ওকে। তুমি কুটতে পারলে আনো,আমি কিন্তু পারবো না।”
ঘরের বাকি কাজ গুছিয়ে নিয়ে আরিফের ছোট মাছ কুটা দেখতে এলো সায়মা।দেখে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না । ছুরি দিয়ে পুঁটি মাছ কাটতে যেয়ে মাছের ভর্তা বানাচ্ছে আরিফ! –
“এভাবে কেউ মাছ কুটে? হয়েছে,আর কাজ দেখাতে হবে না।.জানতাম আমাকেই সব করতে হবে! চোখ রাঙ্গিয়ে বললো সে।
বাধ্য ছেলের মত হাত পরষ্কার করে গুটিগুটি পায়ে রুমে চলে গেলো আরিফ।তাকে বকতে বকতেই মাছ কুটতে বসলো সায়মা।


৪.


দিনদিন আরিফের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে সায়মা। তার কথা হলো,আরিফ কাজের চেয়ে অকাজ করে বেশি।গুছিয়ে কিছুই করতে জানে না!উল্টো সায়মার কষ্ট বাড়ে।সেদিন সাদা মশারিটা আরিফ ধুয়ে দিলো,যেমন কালো ময়লা ছিল তেমনই রয়ে গেছে।হাড়ি-পাতিলসহ যা-ই সে ধোয়,সব আবার সায়মাকে পরিষ্কার করতে হয়।রান্নাঘরে আরিফকে এখন আর সহ্যই করতে পারছে না ও।

এদিকে আরিফের কথা হলো,সায়মার শরীর খারাপ থাকে,সেজন্যইতো হেল্প করে।সে জানে এসময় মুড সুইং একটু বেশিই হয়।তাই বকাবাদ্যিগুলো কানে নেয় না।আরিফের ধারণা সে চমৎকার কাজ পারে,সায়মা একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের হওয়ায় পছন্দ করে না! তবে আজকে সায়মা এসব নিয়ে অনেক বকাঝকা করেছে তাকে।আরিফ তাই মন খারাপ করে ড্রইংরুমে আশ্রয় নিয়েছে।সে বুঝতে পারছে না তার ভুলটা কোথায়!এতদিন সায়মার অভিযোগ ছিল সাহায্য করে না দেখে আর আজ যখন করছে তাতেও তার সমস্যা!

৫.


মায়ের কাছে আরিফের নামে অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো বকা খেল সায়মা। মা বললেন,“ আরিফ তো একমাত্র ছেলে, ঘরে মা-বোন থাকায় ছোটবেলা থেকে ঘরের কোনো কাজ করতে হয়নি।
এখন যে বড়বেলায় অনভ্যস্ত হাতে তোকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে তাতে তো তোর খুশি হওয়ার কথা!!
তুই ওর ভুলগুলোকে হাইলাইট না করে ওকে উৎসাহ দে, সুন্দর করে বুঝিয়ে বল, দেখবি আস্তে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। অবুঝের মতো রাগারাগি করিস না,মা।”
মায়ের কথাগুলো শুনে অনুতাপবোধে আচ্ছন্ন হলো সায়মা। আসলেই তা এভাবে ভেবে দেখেনি ও।

৬.


ড্রইংরুমে এসে সায়মা দেখলো আরিফ ঘুমিয়ে পড়েছে । সোফায় বসে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হলো সায়মার! ধীরে ধীরে মনে পড়লো অতীতের স্মৃতি। প্রথম গ্রাম থেকে যখন শহরে এসছিল তখন!কত বোকা বোকা প্রশ্ন করতো সায়মা। অথচ আরিফ একটুও বিরক্ত না হয়ে হাসিমুখে সব উত্তর দিত। লিফটের ম্যাকানিজম শেখা,শপিং মলের এক্সিলেটর ব্যবহার করা, ব্যস্ত রাস্তা পার হওয়া,ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেওয়া, এটিএম কার্ড এর ব্যবহারশিখিয়ে দেওয়া-এমনই কত ছোট বড় কাজে সে যখন আনাড়ি ছিল,আরিফ কখনো সেসব নিয়ে ব্যাকডেটেড বলে বিদ্রুপ করেনি,বরং সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে।এখনো বাহিরের কত কাজেই আরিফকে পাশে প্রয়োজন হয়…এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের আচরণের জন্য প্রচন্ড অনুশোচনা হলো সায়মার।নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু নামলো।
“এই বউ! কি হয়েছে ? কাঁদছো কেন ? “আরিফের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো সায়মা।
বিব্রত হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো, “তুমি না ঘুমাচ্ছিলে?”
“আরে নাহ! ঘুমের ভান ধরে দেখছিলাম আমার বউটা কি করে! “দুষ্টুমির স্বরে বললো আরিফ।
“আমি সরি”—বলতেই গলাটা ধরে এলো সায়মার।
আরিফ শোয়া থেকে উঠে সায়মার চোখ মুছে দিতে দিতে বললো, “হয়েছে ,এখন আর শোক পালন করো না। বাইরে দেখেছো কী সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে!! খিচুড়ি-ইলিশ রান্না করে তোমাকে খাওয়াতে চাই,মহারানীর অনুমতি কি মিলবে?”
অশ্রুসজল চোখে হেসে ফেলে সায়মা। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন