দৃষ্টির অন্তরালে

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

ভূমিকা:

প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইহকালের জীবন একটি পরীক্ষা মাত্র। এই পরীক্ষার পারফম্যান্সের উপর নির্ভর করে পরকালের জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা।। পরীক্ষার সময় যেমন বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় তেমনি মহান আল্লাহতায়ালাও ইহকালের জীবনে মুসলিমদের বিভিন্ন সমস্যায় নিপতিত করে পরীক্ষা নেন। কাউকে রোগ-ব্যাধি, কাউকে চাকুরি বা ব্যবসা ক্ষেত্রে বিফলতা, কাউকে সন্তানহীনতা, কাউকে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি– এরকম বহুবিধ সমস্যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের ঈমান পরীক্ষা করেন ।

আমরা যদি নবী-রাসূলদের জীবনী পড়ি তবে দেখতে পাবো যে, তাঁরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া স্বত্তেও তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর তাঁরা মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল রেখে , ধৈর্য্য ধরে আ্ল্লাহর কাছে দুআ করেছেন। আল্লাহর কাছেই সমস্যা সমাধানের জন্য ইবাদতের মাধ্যমে নিজেদের সমপর্ণ করেছেন।অথচ বর্তমান যুগের অস্থির সময়ে আমরা যে কোনো সমস্যায় পড়লে বিচলিত হয়ে যাই, তা থেকে দ্রুত উদ্ধার পাওয়ার জন্য শর্টকাট উপায় খুঁজতে থাকি। নিজেরা দুআ ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো সময় ও মানসিকতা আমাদের নেই। সেই সাথে রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক ইসলামিক জ্ঞানের অভাব এবং শয়তানের প্ররোচনা।

আর এসব কিছুর ফলাফল হলো এই যে——পরীক্ষার প্রশ্ন যিনি করেছেন , যথাসময়ে সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান প্রদানের মালিকও তিনি’- এই সহজ সমীকরণে না গিয়ে আমরা পরীক্ষক ও পরীক্ষার্থীর মাঝে তথা মহান আল্লাহ ও বান্দার মাঝে ‘মিডিয়াম বা মাধ্যমের’ অনুপ্রবেশ ঘটাই। এই মিডিয়াম বা মাধ্যম হলো কখনও পীর, হুজুর, কখনও কবিরাজ, কখনও তান্ত্রিক, কখনও মেডিটেশনকারী কখনও বা জ্যোতিষি প্রভৃতি প্রভৃতি……..। আমাদের দুর্বল ইমান এবং কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এসব তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা কখনও আমাদের অতীত বা বর্তমানের অজানা তথ্য দিয়ে চমকে দেন, কখনও অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে তথ্য দিয়ে অভিভূত করেন। কখনও বা সাময়িকভাবে সমস্যা থেকে মুক্ত করে এমন বিশ্বস্ততা অর্জন করেন যে পরবর্তীতে জীবনের যে কোনো সমস্যায় পরলে আবার সেই তাদের কাছেই ফিরে অদৃশ্য আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর এ সব ধরনের কাজই তারা করেন গোপন বা অপ্রকাশ্য উপায় ও উপকরণ ব্যবহার করে।

কি সেই গোপন পদ্ধতি?

কি ঘটে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে?

আদৌ কি তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে?

কিভাবে তারা অপরিচিত ব্যক্তিদের অতীত বা বর্তমান বলে দিতে পারেন?

কিভাবে তাদের বলা ভবিষ্যত বাণী অনেক সময় সত্য হয়ে যায়?

এসব ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য কি?

‘দৃষ্টির অন্তরালে’ সিরিজে আমরা এই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করবো।

পর্ব- ১


প্রায় ১৫ বছর পর বিদেশ থেকে গ্রামে ফিরেছে হায়দার। বিগত বছরগুলোতে গ্রামের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে দেখে বেশ ভালো লাগছে ওর। রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ বেড়েছে, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট তৈরি হয়েছে, গ্রামের অধিকাংশ শিশুই স্কুলে যায়, বাল্যবিবাহ কমেছে, নবজাতক শিশু ও প্রসূতি মায়ের মৃত্যুও কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন বোধহয় হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। গ্রামের তরুণদের হাতে হাতে মোবাইল, তাতে আবার ইন্টারনেট সংযোগ। সারা বিশ্বের সাথে তাদের কানেকশনের প্রভাব তাদের পোশাকের ডিজাইন, চুলের কাটিং, চালচলন আর কথার ফাঁকের শব্দচয়নে স্পষ্ট ।

যাক, গ্রামটা তাহলে সবদিক দিয়েই অনেক এগিয়ে গেছে। বিদেশে আর ফিরে না গিয়ে এবার দেশেই থেকে যাবে কিনা ভাবছিল হায়দার। বাজারের মধ্যে চায়ের দোকানে বসে পুরনো বন্ধুদের সাথে এই বিষয় নিয়েই আলাপ করছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলো নারী, পুরুষ, শিশু, তরুণ, বৃদ্ধের একটি দল বিভিন্ন সাইজের বোতল হাতে নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তের দিকে ছুটছে।

“কি ব্যাপার, সবাই এভাবে বোতল হাতে কোথায় যাচ্ছে?” অবাক কন্ঠে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল হায়দার।
সুজন নামে ওর এক বন্ধু বলল, “গ্রামের শেষ প্রান্তে পুরানো বট গাছের নিচে একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি এসেছেন ১৫ দিন আগে। তার কাছেই যাচ্ছে সবাই। উনার ফুঁ দেয়া পানি খেলে সবরকম সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই বোতল নিয়ে যাচ্ছে ফুঁ দেয়া পানি নিতে।”

“অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি!!!! ধুর কি যে বলিস তোরা? এই যুগে আবার কেউ এসব বিশ্বাস করে নাকি? গ্রামের অবকাঠামোর এত উন্নতি হলেও তোদের মন-মানসিকতার কোনোই পরিবর্তন হয়নি দেখছি।” ব্যঙ্গ করে বলল, হায়দার।

মিলন নামের আরেক বন্ধু বলল, “এসব উন্নয়নের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সম্পর্ক বের করতে চাইছিস কেন তুই? উনি আল্লাহর অনেক বড় ওলী। উনার যা ধর্মীয় জ্ঞান আছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তা আছে নাকি? উনার উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে বলেই তো উনি অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন এবং এমন সব সমস্যার সমাধান দিতে পারেন যা এত বছর কেউ পারেনি।”

“কী এমন অলৌকিক ক্ষমতা আছে উনার ??” অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরেই জানতে চাইল হায়দার।

সুজন উৎসাহের সাথে বলল, “উনি শূণ্যে ভেসে থাকতে পারেন ,পাথরকে স্বর্ণে পরিণত করতে পারেন……আরও এমন অনেক কিছু। উনার এসব অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলেই তো গ্রামের মানুষ উনার কাছে যাচ্ছে । শুনেছি সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে উনার জন্য একটা ভালো থাকার ব্যবস্থাও করে দিবে যেন উনি এই এলাকাতেই রয়ে যান।”

“আসলে তুই-ই অনেকদিন বিদেশে থেকে নাস্তিক হয়ে গেছিস, তাই উনাকে অবিশ্বাস করছিস। ”মিলন বলল হায়দারকে উদ্দেশ্য করে।

আর হায়দার মনে মনে ভাবতে লাগলো, আসলেই কি ঐ ওলীর অলৌকিক ক্ষমতা আছে ? নাকি লোক ঠকানোর জন্য স্রেফ ভাওতাবাজি ? কিন্তু এই ধোঁকাবাজিটাই বা সে করছে কিভাবে? এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর খঁুজে পেল না হায়দার।

উপরের কাহিনীর হায়দার ও তার বন্ধুদের মতো আমরাও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যাপারে দুটি প্রান্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হই। একদল অন্ধভাবে তাদের বিশ্বাস করে তাদের মাধ্যমে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই ,আরেক দল তাদের সবকিছুই ধোঁকাবাজি, কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চাই।

অথচ সত্যিটা হল –এসব তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ লেভেলে গিয়ে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে– ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বরং এসব কিছুই তারা করে জ্বীনদের সাহায্য নিয়ে।

সমস্যা হচ্ছে আমরা অনেকেই মুসলিম হওয়া স্বত্ত্বেও জ্বীনের অস্তিত্বের বিষয়টা ভুত-প্রেতের সাথে মিলিয়ে ফেলি এবং এগুলোকেও কুসংস্কার বা অবৈজ্ঞানিক হিসেবে অস্বীকার করে বসি। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে জ্বীনজগতে বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অংশ, কারণ পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বহু জায়গায় এদের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে সবার প্রথমে বলা যায় সূরা নাসের কথা। ছোট্ট এই সূরাটি আমাদের অধিকাংশের হয়তো মুখস্থ আছে, নিয়মিত নামাযে পড়েও থাকি হয়তো বা। কিন্তু অর্থ না বুঝে পড়ি বলে জানিও না যে এখানে আল্লাহ আমাদেরকে আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন কুমন্ত্রণা দানকারী মানুষ ও জ্বীনের অনিষ্ট থেকে! সুতরাং জ্বীনদের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

হাদীস ও কুরআন থেকে আমরা জ্বীনদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও জানতে পারি। যেমন- তারা দ্রততম সময়ে অধিক দুরত্ব অতিক্রম করতে পারে (২৭:৩৯-৪০), বিবিধ রূপ ধারণ করতে পারে, মানুষের ধমনীর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ তাদেরকে তাদের মূল আকৃতিতে দেখতে না পেলেও তারা মানুষকে দেখতে পারে(৭:২৭)।

জ্বীনদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়েই তথাকথিত অলৌকিক ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। একটা খুব সাধারণ উদাহরণ হলো- কেউ শূন্যের উপর ভেসে আছে দেখে সাধারণ মানুষ হয়তো তাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভেবে অভিভূত হয় অথচ আসল ব্যাপারটা হচ্ছে তাকে সাহায্যকারী জ্বীন হয়তো তাকে হাত দিয়ে তুলে রেখেছে । যেহেতু জ্বীনদের মানুষ দেখতে পায় না তাই সাধারণ মানুষ সেই শূণ্যে ভাসতে সক্ষম মানুষটিকেই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ভেবে বিভ্রান্ত হয় । এভাবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে জ্বীনদের বিভিন্নমুখী সহায়তায় তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা তাদের বিশেষত্ব জাহির করে।

পর্ব-২


ফুয়াদ ও সীমান্ত একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। সহকর্মী হলেও সমবয়সী হওয়ায় ওদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতোই। ফুয়াদের বাবা দিন তিনেক আগে চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছেন। কিন্তু পৌঁছানোর পর থেকে কোনো রকম যোগাযোগ করেননি পরিবারের সাথে। বয়স্ক মানুষ প্রথমবার দেশের বাইরে একা গিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই ফুয়াদের পরিবার খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আজ সকালেও অফিসে বাবাকে নিয়ে টেনশনের কথা বলছিল ফুয়াদ।

রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সীমান্ত তাই একবার ফুয়াদকে ফোন দিল ওর বাবার খবর নেয়ার জন্য।

ফোন ধরার পর ফুয়াদের কন্ঠ অবশ্য নিশ্চিন্তই শোনা গেল। বলল,“কিছুক্ষণ আগে বাবার সাথে কথা হয়েছে। ফোনের সিম কিনতে দেরী হওয়ায় এই কয়দিন যোগাযোগ করতে পারেননি। ”

একথা শুনে সীমান্ত বললো, “যাক অবশেষে তোমাদের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। “

”হুম, তবে আমরা অবশ্য বাবার ফোন পাওয়ার আগে সন্ধ্যাবেলাতেই জানতে পেরেছিলাম বাবা নিরাপদে আছেন “ ফুয়াদের এই কথায় চমকে গেল সীমান্ত।

“কিভাবে, কার মাধ্যমে জানলে?” অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো সীমান্ত।

“আমার বাবার চাচাতো ভাই কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। উনি কমান্ড সেন্টারে বসে মেডিটেশন করে বাবার অবস্থান দেখতে পেয়েছেন, তারপর আমাদের জানিয়েছেন।” রহস্যময় কন্ঠে বলল ফুয়াদ।

“বাংলাদেশে বসে ভারতে তোমার বাবার অবস্থান বলেছেন, এটা কি আদৌ সম্ভব?” সীমান্তের কন্ঠে স্পষ্টতই অবিশ্বাসের সুর।

“যারা কোয়ন্টাম গ্রাজুয়েট হয়ে যান তারা আধ্যাত্মিকতার এমন পর্যায়ে পৌঁছে যান যে ,তারা তখন মেডিটেশনের মাধ্যমে যে কারও অতীত বা বর্তমানের দৃশ্য দেখতে পারেন। আমার চাচাও একজন কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। “ অনেকটা গর্বভরেই কথাগুলো বলল ফুয়াদ।

“অতীতও দেখতে পান? আমার অতীতও চাইলে দেখতে পারবেন তোমার চাচা ?” সীমান্ত জানতে চাইল।

“কিছু তথ্য যেমন তোমার নাম, মায়ের নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি জানালে অবশ্যই পারবেন। অথবা তোমার ছবি দিলেও কাজ হবে।” ফুয়াদের কন্ঠে যেন আত্মবিশ্বাস ঝরে পরছে।

আমার কোনো সিঙ্গেল ছবি তো নেই তোমার কাছে, সব অফিসের গ্রুপ ফটো। আমি বরং আমার তথ্যগুলো মেসেজ করে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি উনার কাছে জানতে চেয়ো তো আমার অতীতের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে। দেখি বলতে পারেন কিনা!!” সীমান্ত বলল।

“আচ্ছা, ফুয়াদ বললো, “রবিবার অফিসে এসে তোমাকে জানাবো তোমার অতীতের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা।”

রবিবার সকালে বেশ উত্তেজনা নিয়ে অফিসে গেল সীমান্ত। ফুয়াদের আসার অপেক্ষায় সময় যেন কাটতেই চাইছে না। অবশেষে ফুয়াদ এসে হাসিমুখে সীমান্তকে বললো, “৫বছর বয়সে নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিলে তুমি। তোমার মামা এসে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করায় সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলে । কি ঠিক বলেছি তো?”’

বিস্মিত সীমান্ত কোনো মতে বললো, “তোমার চাচা বলেছেন এই ঘটনা? ঘটনা তো আসলেই সত্যি!

ফুয়াদ আরও জানালো ওর চাচা নাকি বলেছেন, সীমান্ত ইদানীং খুব দুশ্চিন্তার মাঝে আছে। কারণটাও নাকি উনি জানতে পেরেছেন, তবে ফুয়াদকে তা বলেন নি।

একথা শুনে একদম চমকে গেলো সীমান্ত।

একটু তোঁতলানোর মত করে বলল, “ আ আ আমাকে না দেখে, না জেনে শুধু মেডিটেশন করেই এত কিছু বলে দিলেন!! স্বীকার করতেই হচ্ছে উনি অনেক বড় আধ্যাত্মিক ব্যক্তি।”

সেদিন সারা দিন অফিসে একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করলো সীমান্ত। বার বার ভাবতে লাগলো একবার কি যাবে নাকি ফুয়াদের চাচার কাছে? যদিও ট্র্যাডিশনাল পীর , হুজুরদের উপর আস্থা নেই ওর। তবে ফুয়াদের ফ্যামিলি তো শিক্ষিত, ওর চাচা একজন শিক্ষক। এমন কামেল একজন ব্যক্তিই তো ও খুঁজছিল এতদিন মনে মনে।

বেশ কদিন ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলো সীমান্ত, ফুয়াদের সাথে ওর চাচার কাছে যাবে একবার। বর্তমান ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে উনিই হয়তো ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন!

উপরোক্ত কাহিনীর চরিত্র সীমান্তের মতো আমরাও অনেক সময় কাউকে অতীতের ঘটনা বলে দিতে দেখলে কিংবা বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে খুঁজে দিতে দেখলে তার অলৌকিক ক্ষমতা আছে ভেবে চমৎকৃত হয়ে যাই। সেটা হতে পারে আয়না পরা, চাল পরা, বাটি চালান দেয়া, হিপনোটিজম কিংবা মেডিটেশন প্রভৃতি বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে। কিন্তু আসলে এসব অলৌকিক ঘটনার নেপথ্যের রহস্য কি?
কি ঘটে আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে?

বস্তুত: পৃথিবীতে কোনও মানুষেরই এমন কোন বিশেষ ক্ষমতা নেই যে, সে স্থান-কালের ঊর্দ্ধে যেতে পারে এবং অপরিচিত মানুষের অতীত বা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা এসব কিছু করেন জ্বীনদের সহায়তা নিয়ে। তাদের সাথে খারাপ জ্বীনদের যোগাযোগ থাকে।

তাদের কাছে কেউ যখন কোনো ব্যক্তির অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জানতে চায় তখন তারা তার ‘সাহায্যকারী জ্বীন’কে উক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য জানায়। ‘সাহায্যকারী জ্বীন’ তখন এসব তথ্যের ভিত্তিতে ঐ ব্যক্তির সঙ্গী ‘ক্বারিন জ্বীনে’র সাথে যোগাযোগ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিটি মানুষের সাথেই একজন জ্বীন থাকে যার নাম ক্বারিন। রাসূল (সা:) বলেছেন- “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার সহচর জ্বীন নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি। “ (সহীহ মুসলিম:২৮২৪)

তো এই ক্বারিনের কাজই হলো মানুষকে পথভ্রষ্ট করা, অন্যায়, অশ্লীল ও কুকর্মে প্ররোচিত করা ,,বিপথগামী করা। তাছাড়া সার্বক্ষনিক সঙ্গী হবার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেকের ক্বারিন তার সঙ্গীর অতীত এবং বর্তমান জীবনের সব খুটিনাটি সম্পর্কে জানে।

ক্বারিন তার সঙ্গী ব্যক্তির এসব তথ্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তির ‘সাহায্যকারী জ্বীনকে’ সরবরাহ করে । এভাবে ’সাহায্যকারী জ্বীন’ এবং প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গী ’ক্বারিনের’ কাছ থেকে অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জেনে নিয়ে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে।

এভাবে অপরিচিত ব্যক্তির অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জানতে চাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান কি?

কোনো মানুষ আধ্যাত্মিকতার একটা লেভেলে পৌঁছে অপরিচিত ব্যক্তির অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে জানতে পারে-এমন বিশ্বাস আমাদের শিরকের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এসব অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা,এতে কারো অংশীদার নেই। (সূরা হাশর: ২২) । তাই এভাবে অদৃশ্য জ্ঞানের বিষয়ে জানার চেষ্টা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এর মাঝে রয়েছে অতীত, ভবিষ্যৎ সবই।

অনেক সময় তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের ভবিষ্যত বাণীও সত্যি হয়ে যায়। সেটা কিভাবে?

ব্যক্তির সঙ্গী ক্বারিন জ্বীন কি তার ভবিষ্যতও বলে দিতে পারে?

না , পারে না। তাহলে কিভাবে সম্ভব ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা?

পর্ব- ৩


তিথিদের পাশের ফ্ল্যাটে এই মাসে নতুন প্রতিবেশী এসেছে। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা, তাঁর এক মেয়ে আর এক ছেলে। মহিলার স্বামী নাকি দেশের বাইরে থাকেন। তিথি স্বভাবগতভাবেই খুব একটা মিশুক নয়। তাই যেচে আলাপ করতে গেল না ওদের সাথে। ভদ্রমহিলাকেও কেমন যেন অন্যরকম মনে হলো তিথির কাছে।

প্রায় মাস দুয়েক পর তিথির বাসার ছুটা বুয়া বলল, সে নাকি পাশের ফ্ল্যাটেও কাজ নিয়েছে। ওদের বাসায় প্রায় প্রতিদিন বিকালেই অনেক অতিথি আসে, তাই বিকাল বেলা অতিরিক্ত কাজের চাপ সামলাতে এক ঘন্টার জন্য বুয়াকে আসতে বলেছে। বুয়ার কথায় খুব একটা পাত্তা না দিলেও সেদিন বিকালে মার্কেটে যাওয়ার সময় তিথি লক্ষ্য করে দেখল, আসলেই পাশের ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে অনেক মানুষের জুতা,স্যান্ডেলের সমারোহ। এর মধ্যে বেশির ভাগই অবার মহিলাদের স্যান্ডেল। হয়তো কোনো ধর্মীয় আলোচনার আসর বসে— এই ভেবে তিথি চলে গলে।

মার্কেট থেকে ফেরার পর বাসার নিচে তিথির দেখা হলো কলেজ জীবনের বান্ধবী রিমার সাথে। এখানে কার বাসায় এসেছে জিজ্ঞেস করতেই রিমা বলল, “এই বিল্ডিং এর তিনতলায় একজন মহিলা জ্যোতিষী থাকেন ”,উনার কাছেই এসেছিল রিমা।

তিথি বুঝতে পারল, ওর পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার কথা বলছে রিমা। কিন্তু উনার কাছে কেন এসেছিল জানতে চাইল তিথি।

তখন রিমা উৎসাহ নিয়ে বলা শুরু করলো, ”এই মহিলার তো বিশেষ ক্ষমতা আছে। আমার শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়-স্বজনরা নিয়মিত আসেন উনার কাছে। আমার ননদের বছর দুয়েক আগে এক বখাটে ছেলের সাথে প্রেম ছিল, আমার শ্বাশুড়ি তো চিন্তায় অস্থির। এক আত্মীয় তখন ইনার খোঁজ দিলেন। ইনি আমার শ্বাশুড়িকে একটা বাদামী রংয়ের পাথর দিয়ে বলেছিলেন এই পাথর দিয়ে লকেট বানিয়ে ননদের গলায় পরিয়ে রাখতে। ৬ মাস পর ওর জন্য একটা প্রবাসী ছেলের বিয়ের প্রস্তাব আসবে, তখন নাকি ননদ নিজে থেকেই বিয়েতে রাজী হয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই আমার ননদের এক প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে আর এখন ও স্বামীর সাথে বিদেশে সুখে সংসার করছে।”

রিমার কথায় তিথি অবাক হলেও তা চেহারায় প্রকাশ করলো না। নিরুত্তাপ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “তুই আবার আজ কেন এসেছিলি উনার কাছে?”

রিমা বললো, ”আমার হাজব্যান্ড ওর বন্ধুর সাথে পার্টনারশীপে নতুন একটা বিজনেস শুরু করতে চাইছে । তো বিজনেসটা শুরু করা সেইফ হবে কিনা, এটা নিয়ে কনফিউশনে আছি আমরা সবাই। আমার শ্বাশুড়ির শরীরটা ভালো না, তাই আমাকে পাঠিয়েছিলেন, জ্যোতিষ আপার কাছে।”

”তো কি বললো তোদের জ্যোতিষ আপাা?” তিথি জানতে চাইলো।

রিমা খুব খুশী গলায় বললো, “উনি বললেন , এই ব্যবসায় ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তারপরও সতর্কতা হিসেবে একটা পাথর দিয়ে বললেন , এটা দিয়ে অংটি বানিয়ে পরে থাকলে আমার হাসব্যান্ডের সাথে আর কেউ চিট করতে পারবে না। ”

রিমা এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো বললো যে, তিথিরও কেমন জানি একটা ভক্তি চলে এল, এই না দেখা জ্যোতিষ মহিলার প্রতি। রিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে তিথি ভাবতে লাগল, আসলেই কি সম্ভব এভাবে বিয়ে বা রিজিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্ভূল ভবিষ্যত বাণী করা?

উপরোক্ত কাহিনীর চরিত্র তিথির মতো আমরাও অনেক সময় হাতের রেখা দেখে , টিয়া পাখি/বানরের মাধ্যমে কিংবা গ্রহ-ন্ক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করে অনেককেই ভবিষ্যত বাণী করতে দেখি এবং কখনও কখনও তা মিলে গেলে ঐ ব্যক্তির অলৌকিক ক্ষমতা আছে ভেবে চমৎকৃত হয়ে যাই। আসলে কি ঘটে দৃষ্টির অন্তরালে ?

চলুন, জানার চেষ্টা করি।

বস্তুত পৃথিবীতে কোনও মানুষের এমন কোন বিশেষ ক্ষমতা নেই যে, সে কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যত বলতে পারে। আসলে এসব কিছুই করা হয় জ্বীনদের সহায়তা নিয়ে। এসব তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সাথে যোগাযোগ থাকে। তবে এই জ্বীনরা কোনও ব্যক্তির ভবিষ্যত জানে না। এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গী জ্বীন ক্বারিনও ঐ ব্যক্তির ভবিষ্যত জানে না।

এসব অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর সৃষ্টির কোন অংশকে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন। যেহেতু ফেরেশতারা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষের রিযিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত কাজগুলোর দায়িত্ব পালন করেন তাই তিনি যখন স্বেচ্ছায় ফেরেশতাগণের নিকট কোনো মানুষের ভবিষ্যতের রিযিক সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেন তখন ফেরেশতারা তা জানতে পারেন। আর জ্বীনরা এই সুযোগটাই গ্রহণ করে।

হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর নবুয়্যতের পূর্বে জ্বীনরা আকাশের সীমানায় অবাধে বিচরণ করতে পারতো। আল্লাহ তায়ালা যখন ফেরেশতাদেরকে মানুষের রিজিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত তথ্য জানাতেন তখন শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা সহজেই এসব তথ্য জানতে পারতো। অত:পর তারা এগুলো জ্যোতিষ বা ভাগ্য গণকদের কাছে জানিয়ে দিত। এভাবে শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সহায়তায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জ্যোতিষরা যে ভবিষ্যতবাণী করতো তা অনেকাংশেই সঠিক হতো। একারণে কুরাইশদের কাছে জ্যোতিষদের অনেক কদর ছিল। অগ্রিম খবর বলে দিতে পারতো বলে তারা অনেক শ্রদ্ধাভাজন ছিল।

কিন্তু কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে জীন দের প্রথম আসমান পার হওয়ার ক্ষমতা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং আকাশে প্রহরী ফেরেস্তা নিযুক্ত করা হয়। ফলে শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা অাল্লাহ কর্তৃক ফেরেশতাদের প্রদত্ত নির্দেশগুলো জানতে পারছিল না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

“আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করছি, অতঃপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে জলন্ত উল্কাপিন্ড ওঁৎ পেতে থাকতে দেখে।” (সূরা জ্বীন, ৮-৯)

হঠাত করেই এই রকম পরিবর্তনে অবাক হয়ে শয়তান তার অধীনস্থ সকল জ্বীনদের পৃথিবীর আনাচে-কোনাচে পাঠিয়ে দিল মূল খবর বের করার জন্য- কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে উর্ধ্বাকাশ থেকে কোন খবর আনা যাচ্ছে না?

খবরের সন্ধানে জ্বীনদের একদল যখন নাখালা নামের জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, রাসুল (সঃ) তখন সেই পথে ‘উকাজ’ নামের বাজারে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাচ্ছিলেন। জ্বীনদের দল যখন সেখানে পৌঁছল, রাসুল (সঃ) তখন সাহাবীদের নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ছিলেন। রাসুল (সঃ) এর মুখে কুরআনের তেলাওয়াত শুনেই জ্বীনদের সেই দল বুঝতে পারল কুরআন নাজিল হয়েছে এবং তারা এই সংবাদ নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফেরত যায়।

এরপর থেকে প্রথম আকাশে অবস্থানরত ফেরেস্তারা যখন আল্লাহর নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকে শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা আঁড়ি পেতে টুকরো টুকরো তথ্য সংগ্রহ করে এবং তার সাথে আরও মিথ্যা কথা মিশিয়ে তা জ্যোতিষিদের জানিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল ( সা:) বলেন-

ফেরেশতারা এরপর আকাশের সীমানায় নেমে আসমানে মীমাংসা হওয়া বিষয়ের উল্লেখ করলে জ্বীনরা তা চুরি করে শোনে এবং পরবর্তীতে তার সাথে আরও কিছু কাল্পনিক কথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তা জ্যোতিষীদের কাছে জানিয়ে দেয়। কোন কোন সময় কথা পৌঁছানোর আগে তার উপর অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হয় আবার অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে সে কথা পৌঁছিয়ে দেয় । (সহীহ বুখারী: ৪৮০০)

এভাবেই জ্যোতিষি , ভাগ্য গণকরা নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার কারণে নয় বরং শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সহায়তায় ভবিষ্যত বলে দিতে পারে।

কেউ যদি নিজে জ্বীনদের সাথে সম্পর্ক না রাখে, কিন্তু নিজের বা অন্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে ভবিষ্যত বক্তার কাছে যায় ,তবে তার সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কি?

রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভবিষ্যত বক্তার কাছে যাবে এবং তাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করবে ৪০ দিন তার সালাত কবুল করা হবে না ।(মুসলিম ২২৩০)

আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে,
“যে ব্যক্তি ভবিষ্যত বক্তার কাছে আসে এবং সে যা বলে তাকে সত্য বলে স্বীকার করে সে মুহাম্মদ (সা:) এর উপর যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি কুফরী করল।” (আহমদ)

অর্থ্যাৎ একথা স্পষ্ট যে, অতীত বা বর্তমানের মতো ভবিষ্যতও যেহেতু অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত এবং তাওহীদের অন্যতম মূলনীতি অনুযায়ী আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও এতে অংশীদার নেই তাই কোন ব্যক্তির কাছে অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে জানতে চাওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।


জ্বীনরা কেন তথাকথিত অলৌকিক ব্যক্তিদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে? জ্বীনরা কি তাদের পোষ্য হয়ে যায়?

উত্তর হলো –না। তাহলে জ্বীনদের প্রাপ্তি কি?

পর্ব -৪


পীর, হুজুর, কবিরাজ, তান্ত্রিক, মেডিটেশনকারী কিংবা জ্যোতিষী —-এদের কারোরই নিজস্ব কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, তারা সবকিছুই করে জ্বীনদের সহায়তা নিয়ে।

তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সাহায্যকারী জ্বীন এবং ব্যক্তির সার্বক্ষণিক সঙ্গী ক্বারিন জ্বীনের সহয়তায় অপরিচিত ব্যক্তির অতীত, বর্তমান ,ভবিষ্যত তথ্য জানা সম্ভব হয়।

এখন প্রশ্ন হলো জ্বীনরা কেন এসব তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সহায়তা করে? এটা কি একতরফা কিছু? বা তারা কি এতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে যান যে, জ্বীনরা তাদের বাধ্য বা পোষা হয়ে যায়? তাই তাদের কথামতো কাজ করে?

উত্তর হচ্ছে –না।

সুলায়মান (আ:) ব্যতীত আর কোনো মানুষকে মহান আল্লাহতায়ালা জ্বীনদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেননি। তাই এইসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা যতই অপপ্রচার করুক যে, তাদের বাধ্য বা পোষা জ্বীন আছে তা সত্যি নয়। বরং জ্বীনদের সাথে এইসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সম্পর্কের স্বরূপ হচ্ছে ‘পারষ্পরিক সমঝোতার’, বলা যায় এক ধরণের চুক্তি ।

এই চুক্তির ভিত্তি কি? চলুন, জানার চেষ্টা করি।

মানুষের মাঝে যেমন মুসলিম ও কাফির আছে, জ্বীনদের মাঝেও তেমন আছে।(৭২:১৪) যারা ইবলীসের অনুসারী জ্বীন তারাই মূলত মানুষকে বিপথগামী করার জন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করে, তাদেরকে অর্থ, ক্ষমতা ও খ্যাতির প্রলোভন দেখায়। মানুষের মাঝে একদল স্থূলবুদ্ধি সম্পন্নরা তাদের এই প্রলোভনে সাড়া দেয় এবং জ্বীনদের সাথে সমঝোতার চুক্তি করে।

এই চুক্তি অনুসারে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের শিরকপূর্ণ ও কুফরি কাজ করে। যেমন- কুরআনের মুসহাফের উপর বাথরুম করা, সেটা দিয়ে শৌচকাজ করা, অন্য মানুষ বা পশুপাখির রক্ত পান, বিশিষ্ট কোনো মানুষের রক্ত হাজির করা (ফলে তারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, অনেক সময় করে), জ্বীনদের সিজদাহ করা, তাদের কাছে বিপদে আশ্রয় চাওয়া, তাদের নামে প্রাণী উৎসর্গ করা ইত্যাদি। তখন এসব শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের উপর সন্তুষ্ট হয় এবং বিভিন্নভাবে তাদের সহায়তা করে।

এভাবে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সহায়তা করে জ্বীনদের প্রাপ্তি কী?

জ্বীনদের পুরস্কারটা আসে ইবলিসের পক্ষ থেকে। ইবলিসের মিশনই হচ্ছে যত বেশী সংখ্যায় সম্ভব আদম সন্তানকে তার সাথে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া। আর এই মিশনে সে তার অনুসারী জ্বীনদেরও ব্যবহার করে। তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সাহায্য করার বিনিময়ে তারা যখন তাদেরকে দিয়ে শিরক ও কুফরি কাজ করাতে সমর্থ হয়, তখন তারা তাদের লক্ষ্যে এক ধাপ এগিয়ে যায়। সাথে বোনাস হিসেবে তারা পায় সেইসব সাধারণ মানুষ যারা এসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিভ্রান্ত হয়ে তাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসে এবং নিজেদের অজান্তেই নানারকম শিরকপূর্ণ ও কুফরি কাজে লিপ্ত হয়।

এভাবে আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও তাদের কাছে আসা সাহায্যপ্রার্থী –এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বিপথগামী করার পুরষ্কারস্বরূপ জ্বীনরা ইবলিসের কাছ থেকে বাহবা পায়। রসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন :
ইবলিস সমুদ্রের পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য সেখান থেকে তার বাহিনী চারদিকে প্রেরণ করে।
এদের মধ্যে সেই তার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে মানুষকে সবচেয়ে বেশী ফিতনায় নিপতিত করতে পারে। (সহীহ মুসলিম ২৮১৩)

ইবলিশ শুধু যে তার কাজে সহায়তাকারী জ্বীনদের সাময়িকভাবে পুরস্কৃত করে তাই নয় বরং তাদের অনন্তকালের জীবনে ক্ষমতা এবং রাজত্বের প্রলোভনও দেখায়। যদিও শয়তানের কোনোই সাধ্য নেই তাদেরকে চিরস্থায়ী পুরস্কার দেয়ার। তাই কিয়ামতের দিন সে নিজের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কথা স্বীকার করে নিয়ে বলবে-

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। অতএব তোমরা আমাকে ভৎর্সনা করো না এবং নিজেদেরকেই ভৎর্সনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্যকারী নই। এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতোপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি। নিশ্চয় যারা জালেম তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (১৪:২২)

এভাবে শয়তানের অনুসারী জ্বীনদের সাথে সমঝোতায় যাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

দুনিয়াবী স্বার্থসিদ্ধির জন্য জ্বীনদের সাথে এই ধরনের সমঝোতায় যাওয়া মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এসব কিছুর পরিণাম হলো জাহান্নাম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে—

আর যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে সমবেত করবেন সেদিন বলবেন, হে জ্বীনের দল, তোমরা অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিলে এবং মানুষদের মধ্যে থেকে জ্বীনদের সঙ্গীরা বলবে, হে আমাদের রব, আমরা এক অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং আমরা পৌঁছে গিয়েছি সেই সময়ে, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ বলবেন, আগুন তোমাদের ঠিকানা,তোমরা সেখানে স্থায়ী হবে। (সূরা আল-আনঅম: ১২৮)

অতএব মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক ইসলামিক জ্ঞান আহরণ করা এবং মহান আল্লাহ ছাড়া তাঁর যে কোন সৃষ্টির কাছে ( জ্বীন অথবা তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ) সাহায্য চাওয়ার মানসিকতা পরিহার করা।

তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সাহায্য নিতে গিয়ে মুসলিমরা কিভাবে নিজের অজান্তেই শিরকে জড়িয়ে পড়ে?

পর্ব -৫

গ্রীষ্মের ছুটির দীর্ঘ এক মাস পরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। প্রথম দিন বন্ধুরা সবাই এক অপরের সাথে কুশল বিনিময় করছে। রায়হান ও সিয়াম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই ভালো ছাত্র। ১৫ দিন পর ওদের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। তাই বন্ধের মধ্যেও পড়ার চিন্তা মাথায় ছিল ওদের।
“ কিরে পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন নিলি?” রায়হান জিজ্ঞেস করলো সিয়ামকে।
সিয়াম বললো, “ভালোই আলহামদুল্লিাহ। দিনের বেলা ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলেও রাতের বেলা নিয়ম করে পড়েছি। সিলেবাস প্রায় কমপ্লিট। তোর কি অবস্থা?”
রায়হান বিমর্ষ স্বরে বলল, “আমার পড়া তেমন কিছুই আগায়নি। ছুটির একটা মাস তো অসুস্থ অবস্থায় বিছানাতেই কেটে গেল। পড়তে আর পারলাম কই?”
“কেন, কি হয়েছিল তোর?” উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সিয়াম।
রায়হান বললো, “বাড়ি ফেরার দুই-তিন দিন পর থেকেই সারা শরীরে ব্যথা, মাথা ঘুরে, বমি বমি ভাব আর খাওয়ায় অরুচি।”
“ডাক্তার দেখাসনি?” সিয়াম জানতে চাইলো।
“হুম, গ্রামের ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। উনি বললেন, গরমে গ্যাস ফর্ম করে শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে। গ্যাসের ওষুধও দিলেন। কিন্তু ওষুধ খেয়ে তেমন কোনো কাজ হলো না।”
“বলিস কি? এজন্যই তোর চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। কালই চল, আমার মামার কাছে নিয়ে যাই। উনি ভালো ডাক্তার। ”
“নারে, আপাতত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আমার সমস্যা ডাক্তার সমাধান করতে পারবে না। ডাক্তারের ওষধে কাজ না হওয়ায় মার সাথে গ্রামের হুজুরের কাছে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, আমার এটা সাধারণ অসুস্থতা না। আমার নাকি বদনজর লেগেছে।”
“কি বলিস!! তোকে কে বদনজর দিতে যাবে??” অবাক কন্ঠে বলল সিয়াম।
“কার বদনজর লেগেছে তা অবশ্য হুজুর বলেননি। তবে আমরা আন্দাজ করতে পেরেছি। জানিসই তো, আমি বাবার একমাত্র ছেলে। বাবার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আমি। আমার অন্য চাচাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া আমাদের গ্রামের মধ্যে আমিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, ভালো ফলাফলও করছি , তাই আমাকে হিংসা করার লোকের অভাব নেই গ্রামে। যাই হোক, আপাতত আর চিন্তা নেই। হুজুর আমাকে তাবিজ দিয়ে দিয়েছে।” নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলল রায়হান।
“তাবিজ?? তুই একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে তাবিজ পরেছিস?” অবিশ্বাসের সুরে বলল সিয়াম।
“তো কি হয়েছে? তাবিজে তো হুজুর আল্লাহর কালামই লিখে দিয়েছেন। উনার দেয়া তাবিজ পরার পর থেকে আমার শরীরও আগের চেয়ে ভালো।” বেশ ভক্তিভরা কণ্ঠে বলল রায়হান।
“তুই নিশ্চিত যে ঊনি আল্লাহর কালাম লিখে দিয়েছেন? আমি ইউটিউবে একবার একটা ভিডিওতে দেখেছিলাম যে অনেক সময় তাবিজের মধ্যে উল্টা পালটা অনেক কিছু লেখা থাকে।” বলে উঠল সিয়াম।
“আরে নাহ! কী যে বলিস! আমাদের হুজুর অন্যরকম কামিল লোক। তাছাড়া ঊনি তাবিজ বানিয়ে দেন নাই। খোলা কাগজটা আমাদের দিয়েছিলেন আর শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে দুআ পরে ওটাকে মোম দিয়ে খোলসটার মাঝে আটকাতে হবে। আমি সেই নিয়ম অনুসরণ করে তারপর পরেছি। তাই আমি জানি যে কাগজে কী লেখা আছে। আমিতো আরবী একটু আধটু পড়তে পারি। ওখানে আরবীই লেখা ছিল।”
রায়হানের এই আত্মবিশ্বাস দেখে সিয়াম প্রতিবাদের ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলল।

উপরের কাহিনীর রায়হানের মতো অনেকেই অসুস্থতা/ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিংবা যে কোনো কল্যাণের আশায় পীর, হুজুর বা কবিরাজের দেয়া তাবিজ, বিশেষ ধরনের সুতা, ব্রেসলেট বা লকেট পরিধান করে। কেউ কেউ আবার শরীরে পরিধান না করলেও ঘরের দেয়ালে, যানবাহনে বা দোকানে ঝুলিয়ে রাখে। কেউ বা আবার কুরআনের আয়াত লেখা কাগজ পানিতে ধুয়ে খায়।

কিন্তু আমরা কি জানি আসলে এসব কাগজে কি লেখা থাকে?

আমরা অধিকাংশ সময়েই এগুলো খুলে দেখার কথা চিন্তাও করি না কারণ এগুলো যিনি দিয়েছেন আমরা তাদের আধ্যাত্মিকতার উপর অন্ধভাবে আস্থা রাখি। যদিও বা কালে ভদ্রে রায়হানের মত কারো খোলা অবস্থায় কাগজটা দেখার সুযোগ হয়, আরবী লেখা বা আরবী সদৃশ লেখা দেখে আমরা নিশ্চিন্ত মনে ভেবে নেই যে এখানে আল্লাহর কালাম লেখা আছে। কিন্তু আসলে কি তাই?

আসুন নিচের সম্ভাবনাগুলো নিয়ে একটু চিন্তা করি ।

প্রথমত: তাবিজে হয়তো আসলেই আয়তুল কুরসী, তিন কূল, সূরা ইয়াসীন কিংবা কুরআনের কোনো আয়াত সংক্ষিপ্ত আকারে আরবীতে লেখা আছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাবিজ পরিধান করা ইসলামসম্মত নয়। কারণ এগুলো পরা অবস্থাতেই শৌচাগারে যাওয় হয়, নাপাকী অবস্থাতে পরে থাকা হয়। এভাবে আসলে সূুক্ষ্মভাবে আল্লাহর আয়াতকে অমর্যাদা করা হয় এবং পরোক্ষভাবে শয়তানকেই খুশি করা হয়। কারণ কুরআন অবমাননা করা শয়তানের অনেক পছন্দের একটি কাজ।

তাছাড়া রাসূল (সা:) কুরআনের আয়াত পাঠের মাধ্যমে নিজে চিকিৎসা করেছেন এবং অন্যকেও করতে শিখিয়েছেন। কখনও একে তাবিজ হিসেবে ব্যবহার করেননি। ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন গলায় ঝুলিয়ে রাখলে যেমন অসুখ ভালো হয় না, তেমনি আল্লাহর কালাম ঝুলিয়ে রাখলে,, সেটার উপর আমল না করলেও তা কার্যকরী হয় না।

দ্বিতীয়ত: কিছু তাবিজে সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন আরবি হরফ লেখা থাকে। সংখ্যাতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী একেকটি আরবী হরফের বিপরীতে একেকটি সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। যেহেতু কোন সংখ্যার বিপরীতে কোন শব্দ আছে তা সাধারণ মানুষের জানার কোনো উপায় নেই, তাই এর মাধ্যমে সহজেই মানুষকে ধোঁকা দেয়া যায়। যেমন ৭৮৬ অর্থ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এটি সংখ্যাতত্ত্বের খুব প্রচলিত একটি উদাহরণ, যদিও এখানে ৭,৮,৬ সংখ্যার বিপরীতে আসলে কি শব্দ আছে তা সাধারণ মানুষ জানে না

যদি সত্যিই এখানে সংখ্যাতত্ত্বের মাধ্যমে আল্লাহর কালাম লেখা থাকে তবে সেক্ষেত্রেও তা ইসলাম সম্মত নয়। কারণ কুরআন আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে তাই কুরআনের কোনো আয়াতকে নকশা বা অন্য কোনো সংকেতে পরিবর্তন করা ইসলাম অনুমোদন করে না।

তাছাড়া এমনও হতে পারে এই সংকেতগুলোকে ডিকোড করলে দেখা যাবে -এগুলোতে দিন বা মাসের বিশেষ সময় কিংবা গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থানের হিসাব লেখা রয়েছে, যে সময়গুলোতে শয়তানের উপাসনা করা হয়। সেক্ষেত্রে এসব সংকেত লিখিত তাবিজ পরিধানের মাধ্যমে হয়তো শয়তানের উপাসনা করা হচ্ছে।

তৃতীয়ত: তাবিজ এর লেখাগুলো দুর্বোধ্য হওয়ায় এসব লেখার মাধ্যমে অনেক সময় সুকৌশলে শয়তানের প্রশংসা করে তার আশ্রয় চাওয়া হয় যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। কারণ এসব ক্ষেত্রে তাবিজের লেখার শুরুতে এবং শেষে বড় করে বিসমিল্লাহ, আল্লাহ এসব শব্দ লিখে মাঝখানে এমনভাবে একটা বা দুইটা শব্দ পরিবর্তন করে শয়তানের নাম (যেমন- ইয়া বাদ্দুহ।) লিখে দেয়া হয় যে আপাতদৃষ্টিতে এটা বোঝা সম্ভব হয় না আসলে কোন জায়গায় পরিবর্তনটা করেছে। কখনও বা আবার আল্লাহর নাম মাঝখানে রেখে চারপাশে শয়তানের নাম লিখে রাখা হয়।

কোনো কোনো তাবিজে বহুভূজ, বৃত্ত প্রভৃতির চিত্র অঙ্কিত থাকে যেগুলো কুরআনের কোথাও উল্লেখ নেই বরং এগুলো শয়তানের উপাসকদের সিল হিসেবে পরিচিত।

তাই এসব তাবিজ পরিধানের মাধ্যমে মুসলিমরা নিজের অজান্তেই আল্লাহ্‌ নয় বরং শয়তানের ভরসায় নিজেদেরকে সমর্পণ করে, শয়তানের উপাসনা করে। (আস্তাগফিরুল্লাহ) এটা এমন একটা সম্ভাবনা যে সেটা যদি ০.০০০০১% ও হয়, তাহলেও সেটা সর্বাংশে এড়িয়ে চলা উচিৎ।

তাবিজ বা এজাতীয় জিনিস পরিধান বা ঝুলানোর ব্যাপারে কুরআন ও হাদীস কি বলে?

মানুষের জন্য যা কিছু কল্যাণ তা একমাত্র মহান আল্লাহর নিকট থেকেই আসে আর কারও জন্য কোনো ক্ষতি নির্ধারিত হলে সেটাও একমাত্র আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে । এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমত উন্মুক্ত করে দেন তা আটকে রাখার কেউ নেই। আর তিনি যা আটকে রাখেন, তিনি ছাড়া তা ছাড়াবার কেউ নেই। আর তিনি পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।” (৩৫:২)

তাই তাবিজে লেখা কাগজের মাধ্যমে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক মনে করে তার কাছে আশ্রয় চাওয়া নি:সন্দেহে শিরক।

মহানবী (সা: ) এন কাছেও তাবিজ পরিধান কতটা অপছন্দনীয় ছিল তা নিচের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। উকবা বিন আমির (রা:) থেকে বর্ণিত, “ একবার মহানবী (সা:) এর কাছে একদল লোক আসলে তিনি নয়জনের বায়াত গ্রহণ করলেন এবং একজন থেকে বিরত থাকলেন। তারা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে মহানবী (সা:) বললেন, ঐ ব্যক্তির দেহে তাবিজ রয়েছে। অত:পর সেই তাবিজ ছিঁড়ে ফেললে মহানবী (সা:) তার বায়াত নিলেন এবং বললেন , যে তাবিজ লটকালো সে শিরক করল। (আহমদ)

সুতরাং একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, তথাকথিত পীর, হুজুর, কবিরাজদের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে তাদের দেয়া তাবিজ বা এজাতীয় জিনিস পরিধান করলে নিজের অজান্তেই শিরকে লিপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে ; যেহেতু কোনও তাবিজ জায়েজ কিনা সেটা যাচাই করার মত জ্ঞান আমাদের নেই।

আল্লাহতায়ালা আমাদের অজ্ঞতাজনিত শিরক থেকে রক্ষা করুন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন