কোয়ান্টাম মেথড আমাদের কোন পথে ডাকছে?

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

পর্ব ১

লাইব্রেরীর পাশ দিয়ে আসছিলাম, ক্রিস্টানদের একটা গ্রুপ লিফলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে লেখা ‘আমাদের কাছেই আছে শান্তি’। পড়ে একটু মুচকি হাসলাম। শান্তি পাওয়ার জন্য আমাদের ব্যাকুলতাটা এতটাই তীব্র যে এটা পাওয়ার কথা সবাই তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে।

এই ‘শান্তির’ কন্সেপ্টটা ইসলামের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা মুসলিমরা যখন একজন আরেকজনকে সম্ভাষণ জানাই তখন প্রথমেই বলে থাকি আল্লাহ আপনার উপর শান্তি বর্ষণ করুন। আমরা বলে থাকি ইসলাম শান্তির ধর্ম, দাবী করি ইসলাম মেনে চললে জীবনে শান্তি অবধারিত।

কিন্তু চারপাশে তাকালে তা কি দেখতে পাই আমরা?

উত্তর মনে হয় এক কথায় না। চারদিকে কান পাতলেই আমরা শুনতে পাই তীব্র হাহাকার, শান্তির খোঁজে অসংখ্য ডুবন্ত মানুষ খড়কুঁটো ভেবে যা পাচ্ছেন তাকেই আঁকড়ে ধরছেন। এমন একটা খড়কুঁটো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ‘কোয়ান্টাম মেথড’। আজকে আমরা কুরআন সুন্নাহর আলোকে এটাকে একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।[1]

কোয়ান্টাম মেথড আসলে কী ?

এককথায় এটা মেডিটেশন বা ধ্যানের টেকনিক। তাদের ভাষায় আশ্রম ও খানকার চৌহদ্দি থেকে বের করে ধ্যানকে গণমানুষের আত্মউন্নয়ন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রয়োগ করাই উনাদের উদ্দেশ্য।

আমরা হয়তো শুনে এসেছি যে মুনি ঋষি বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা ধ্যান করে নানা অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করতেন। কোয়ান্টাম মেথড এই প্রক্রিয়াটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায়। তাদের কথা হল সকল মানুষের মাঝেই অপার সম্ভাবনা আছে, সব মানুষই মেডিটেশন করে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে। মেডিটেশন করে কী কী উপকার পেয়েছে এহেন কেস স্টাডির বিশাল লিস্ট ওদের ওয়েব সাইটে গেলে পাওয়া যায়। তাদের বক্তব্যের সারাংশ হচ্ছে-

o মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার‘অন্তরের আমি’র সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে।

o মেডিটেশনের পথ ধরেই আপনি অতিক্রম করতে পারবেন আপনার জৈবিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা। দৃশ্যমান সব কিছুর পেছনে কাজ করছে স্পন্দন ও নিয়ম যা মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে মেডিশনের মাধ্যমে।

o মানুষের ব্রেন একটা কম্পিঊটারের মত। এটা সকল প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক। আর ব্রেনকে সুসংহতভাবে ব্যবহার করার নেপথ্য নায়ক হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি।

o মেডিটেশনের বিভিন্ন লেভেল রয়েছে। বিভিন্ন লেভেল ব্রেনের ওয়েভ প্যাটার্ণের সাথে মিলে যায়। যেমন মেডিটেশনের প্রথম ধাপ হচ্ছে ‘শিথিলায়ন’[2] যার মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভকে আলফা লেভেলে নিয়ে মনের ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করা হয়।

o থিটা লেভেল অনেক উচ্চস্তরের লেভেল। তাদের দাবী মেডিটেশনকালে সাধকরা এই স্তরে প্রবেশ করেই মহাচৈতন্যের (super consciousness) সাথে সংযোগ স্থাপন করতেন। এর পরবর্তী লেভেল-ডেল্টাতে দরবেশ ঋষিরা এই স্তরেও সজাগ থাকেন আবার মহাচৈতন্যে লীনও হতে পারেন। [3]এই মহাচৈতন্যের সংজ্ঞা বইটির কোথাও সুস্পষ্টভাবে দেয়া নেই।

ইসলামের দৃষ্টিতে কোয়ান্টাম

মেডিটেশনের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

উপরে আমরা মেডিটেশনের ব্যাপারে যা বললাম তা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে এখানে মানুষকেই প্রকারান্তরে সকল ক্ষমতার উৎস ধরা হচ্ছে। মেডিটেশন একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ তার মনের উপর এমন লেভেলের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘মন ছবি’ টেকনিকটার কথা। বইতে উল্লেখিত নিচের ঘটনাটা একটু দেখি-

এক ইঞ্জিনিয়ার। সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগল। ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। ভিসা পাওয়ার পর মনছবি দেখতে লাগল সমমানের চাকরির, যাতে নিজের প্রকৌশল জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারেন। দেশে তিনি কাজ করতেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানে। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যে একই প্রতিষ্ঠানে আগের চেয়েও দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি হয়ে গেল তার। [4]

আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে মনের স্বাধীন শক্তির এই ধারণাটি ইসলামের শিক্ষার সাথে রীতিমত সাংঘর্ষিক। এভাবে নিজের ‘আমিত্ব’কে পরোক্ষভাবে ইলাহ/উপাস্য বানিয়ে দেয়া হয়। জৈবিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা বা স্থান-কালের ঊর্ধ্বে যেতে পারাও সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে।

অন্তরের ইবাদতসমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল “তাওয়াক্কুল” – যা আল্লাহ ছাড়া আর কারও ওপর করা যাবে না। কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া এমন কোন সত্তার ওপর এমন কোন ব্যাপারে তাওয়াক্কুল করে যা সংঘটনের ক্ষমতা তার নেই, তবে তা বড় শিরক হবে যা একজন ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডীর বাইরে নিয়ে যায়।

এছাড়াও এ সংক্রান্ত আরো একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মহাচেতনার সাথে বিলীন হয়ে যাওয়ার কনসেপ্টটা। এটা আসলে হিন্দু ধর্মের একটা কনসেপ্ট যেখানে মানুষকে ঈশ্বরের অংশ ভাবা হয় এবং জন্ম পুনর্জন্মের চক্র থেকে মানুষ মুক্তি পায় তখন তার আত্মা ব্রক্ষ্মের সাথে মিশে যায়। এটাকে তারা নির্বাণ বা ফানাফিল্লাহ বলে থাকে যেটার কথা কোয়ান্টামের বইটিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বেশ্বরবাদ কিংবা মানুষের ভিতর ঈশ্বরের অস্তিত্বের যে ইঙ্গিত এভাবে দেয়া হয়েছে – ইসলামের দৃষ্টিতে তা একাধারে ‘কুফর’ ও ‘শিরক’। ইসলামে আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্ত্বা এবং তাঁর সাথে সৃষ্টির কোনো সাদৃশ্য নেই। [সূরা আশ-শূরা :১১]

তবে এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে মনকে স্বাধীন শক্তি হিসেবে চিন্তা না করে আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা’লাকে যদি সকল ক্ষমতার উৎস ভাবা হয় তাহলে মেডিটেশনের মাধ্যমে কিছু কিছু টেকনিক শেখা যায় যা জীবনের কিছু ক্রিটিক্যাল মুহুর্তে আসলেই কাজে লাগে। যেমন যে কোনো Pre Natal কোর্সে কিছু Breathing Technique শিখানো হয় যা লেবার পেইনের প্রচণ্ড ব্যাথাকে মোকাবিলা করতে বা এইসময়ে কিছুটা হলেও রিল্যাক্স থাকতে সাহায্য করে।

মেডিটেশনের সাথে জড়িত আরো টেকনিক: কোয়ান্টা সংকেত ও কোয়ান্টা ভঙ্গী

মেডিটেশনের সময় ওরা আরো কিছু টেকনিক শিখায় যার মাঝে কোয়ান্টা সংকেত ও কোয়ান্টা ভঙ্গী অন্যতম।

কোয়ান্টা সংকেত

কোয়ান্টা সংকেত হল একই শব্দ অসংখ্যবার উচ্চারণ যা মনোদৈহিক স্পন্দন সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ফলে মানুষ তার মনোদৈহিক শক্তি পুরোপুরি একাগ্রভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।

কোয়ান্টা সংকেতের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য ইসলামেও বিভিন্ন বাক্য একাধিকবার বলাকে আমরা যিকির বলে থাকি যেটা একটা প্রতিষ্ঠিত ইবাদাত। আমরা মূলত করি পরকালের পুরষ্কারের আশায় তবে এটাও ঠিক যে তা মনোযোগ একীভূত করতে বা স্ট্রেস রিলিফে সাহায্য করে। তাই কোয়ান্টা সংকেত অনুমোদিত হবে নাকি সেটা নির্ভর করছে আমরা কোনো শব্দ পড়ছি তার উপর। আল্লাহ, ইয়াহু, ইয়া হক এসব অর্থহীণ শব্দ পড়ার কোনো মানে হয় না। ওম বা এই টাইপের অন্য ধর্মের শব্দ পড়া নিঃসন্দেহে নিষেধ।

কোয়ান্টা ভঙ্গি

কোয়ান্টা ভঙ্গি হল অভয়মুদ্রার আধুনিক নাম। বুদ্ধসহ প্রাচীন ঋষিদের ভাস্কর্যে আমরা সাধারণত হাতের যে ভঙ্গি দেখি, সেটাকেই অভয়মুদ্রা বলে। কোয়ান্টাম মেথডের বইটিতে তারা কোয়ান্টা ভঙ্গির[5] জ্যোতিষ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিচ্ছে- হাতের বুড়া আঙ্গুলের ক্ষেত্র হল শুক্র বা ভেনাসের ক্ষেত্র । আর তর্জনীর ক্ষেত্র হচ্ছে বৃহস্পতির ক্ষেত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে শুক্র ও বৃহস্পতি কল্যাণ ও সাফল্যের প্রতীকরূপে গণ্য। আর মধ্যমার ক্ষেত্র শনির ক্ষেত্র রূপে পরিচিত। শনি বিলম্ব ও বাধার প্রতীক। প্রাচীন ঋষিরা এ কারণেই ভেনাস ও জুপিটারের প্রবৃদ্ধিকেই সংযুক্ত করেছেন, এর সাথে শনির প্রভাবকে যুক্ত করতে চাননি।

তারপর সেটার ইসলামীকরণের একটা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এটা বলে-কোয়ান্টা ভঙ্গি করে হাত সামনে এনে খেয়াল করলে দেখবেন হাতে আরবী আলিফ, লাম ও হে অর্থ্যাৎ আল্লাহু হয়ে আছে। অর্থ্যাৎ কোয়ান্টা ভঙ্গি করার সাথে সাথে আপনি প্রকারান্তরে স্রষ্টাকে স্মরণ করছেন।

কোয়ান্টা ভঙ্গির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

কোয়ান্টা ভঙ্গীকে আল্লাহকে স্মরণ করার যে উপায় হিসেবে দেখানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অভিনব একটি বিদ’আতের উদাহরণ। আল্লাহর স্মরণ বা যিকির ইসলামের একটি প্রতিষ্ঠিত ইবাদাত। তাই এর উৎস অবশ্যই ওহী হতে হবে। আর কোয়ান্টা ভঙ্গীর যে অ্যাস্ট্রোলজিকাল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে ইসলামে যে এটা পরিত্যাজ্য তা দিবালোকের মত পরিষ্কার। জ্যোতিষশাস্ত্র, রাশিচক্র এবং অনুরূপ ভ্রান্ত বিদ্যাগুলোর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থা ও অবস্থান দেখে কোন ঘটনা, ভাগ্য বা ভবিষ্যত নির্ণয় করা। এই বিদ্যাচর্চার দুটি তাওহীদ বিরোধী দিক রয়েছে:

প্রথমত: এই ধারণা করা যে গ্রহ-নক্ষত্র মহাবিশ্বের ঘটনাবলীকে সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, এই ধারণা মূলত রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শিরক করার সমতুল্য।

দ্বিতীয়ত : গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ণয়ের চেষ্টা, যা কিনা আল্লাহ পাকের অদৃশ্যের জ্ঞানের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অপরকে শরীক করার শামিল।

————————————————————————————————————————

তথ্যসূত্র:
[1] এই লেখাটিতে ব্যবহৃত কোয়ান্টাম মেথড সংক্রান্ত সকল তথ্য তাদের ওয়েবসাইট, লিফলেট এবং টেক্সটবুক (সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড – মহাজাতক, পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণঃ জানুয়ারী, ২০০০) থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।

[2] ‘শিথিলায়ন’ পুরোপুরি আয়ত্ত হলেই আপনি মনের শক্তিবলয় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হাতে পাবেন। ধ্যানাবস্থায় মন হয় ত্রিকালদর্শী, চেতনা অতিক্রম করে সকল বস্তুগত সীমা। মনের এই ধ্যানাবস্থার শক্তিকে প্রয়োগ করেই প্রাচ্যের সাধক দরবেশ ঋষিরা একদিন আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ইচ্ছা করেছেন – ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন – মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। আপনিও এ চাবিকাঠিকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করতে পারেন অতিচেতনা। এই চাবিকাঠি দিয়েই দৃশ্যমান সব কিছুর পেছনে যে নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম কাজ করছে তার সবটাকেই আপনি নিজের ও মানবতার কল্যাণে সক্রিয় করে তুলতে পারবেন।’’ বইয়ের পৃঃ ৫৯

[3] বইয়ের পৃঃ ৫৮

[4] বইয়ের পৃঃ ১১৫

 

পর্ব ২

মেডিটেশনের পরবর্তী ধাপগুলো

আমরা আগেই বলেছি যে মেডিটেশনের একাধিক ধাপ রয়েছে। আমরা যে বইটি থেকে রেফারেন্স দিয়েছি সেখানে ধ্যানের প্রথম ধাপের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়েছে। পরবর্তীতে বাকি ধাপগুলোর ব্যাপারে শুধু আভাস দেয়া হয়েছে যাকে বলা হয়েছে অতিচেতনার পথে যাত্রা।
যারা কোয়ান্টাম এর গ্র্যাজুয়েট হন, তারা দেখা যায় আরো কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করেন। যেমন কমাণ্ড সেন্টার এবং অন্তর্গুরুর দেখা লাভ। নিচে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হল-

কমান্ড সেন্টার

কমান্ড সেন্টারকে তারা বলে মনের বাড়ির শক্তি ও কল্যাণ কেন্দ্র। তাদের ভাষায় মানব অস্তিত্বের যে অংশ স্থান কালে আবদ্ধ নয়, সে অংশ এই কমান্ড লেভেলে প্রকৃতির নেপথ্য নিয়ম ও স্পন্দনের সাথে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করে । যাকে তারা জীবনে কখনও দেখেননি, যার কথা জীবনে কখনও শোনেননি, শুধু তার নাম, বয়স ও ঠিকানা বলার সাথে সাথে তার এমন হুবহু বর্ণনা দিতে সক্ষম হন কোয়ান্টাম গ্র্যাজুয়েটরা যে প্রশ্নকর্তা নিজেই অবাক হয়ে যান।
কমান্ড সেন্টারের প্রয়োগ

ছেলে কোলকাতায় গিয়েছে, যাওয়ার পরে ২ দিন কোন খবর নেই। বাবা কোয়ান্টাম গ্র্যাজুয়েট, মাগরিবের নামাজ পড়ে মেডিটেশন কমান্ড সেন্টারে গিয়ে ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করতেই কোলকাতার একটি সিনেমা হলের গেট ভেসে এল। ছেলে সিনেমা হলের গেটে ঢুকছে। বাবা ছেলেকে তার উদ্বেগের কথা জানালেন। বললেন শিগগিরই ফোন করতে। [6]

কমান্ড সেন্টারের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

আল-কুরআন এবং হাদীসে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে গায়েবের জ্ঞান বা অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহ পাকের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্য, এতে কারও কোন অংশীদারিত্ব নেই। গায়েবের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে এমন সবকিছু যা মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা জানা যায় না। সেটা হতে পারে অতীতের ঘটনা, কিংবা ভবিষ্যতের ঘটনা কিংবা দূরত্বের কারণে মানুষের জ্ঞান থেকে অন্তরালে থাকা কিছু যেমন জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ পাক চাইলে তাঁর সৃষ্টির কোন অংশকে জানাতে পারেন, যেমন তিনি নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারফত আমাদেরকে জান্নাত জাহান্নামের বিবরণ জানিয়েছেন। তেমনি আল্লাহ পাক পৃথিবীতে মানুষের রিযিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত তথ্য ফেরেশতাগণের নিকট প্রকাশ করলে তাঁরা তা জানতে পারেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নবী-রাসূল কিংবা ফেরেশতারা গায়েব জানেন বরং গায়েবের জ্ঞানের একাংশ আল্লাহ পাক তাদেরকে জানালে তবেই কেবল তারা তা জানতে পারে। আর তাই এটি ইসলামী আকীদার একটি অন্যতম মূলনীতি যে গায়েবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্য, এতে কারো অংশীদার নেই।

কিন্তু কমাণ্ড সেন্টারের প্রয়োগ দেখলেই আমরা বুঝব তা মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দাবী করছে যখন সে গায়েবের জ্ঞানের অধিকারী হয়।

অন্তর্গুরু

কোয়ান্টামের দাবী-আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে হলে একজন আলোকিত গুরুর কাছে বায়াত বা দীক্ষা প্রয়োজন। এছাড়া আধ্যাত্মিকতার সাধনা এক পিচ্ছিল পথ। যে কোন সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাতে পড়ে যেতে পারেন।কমান্ড সেন্টার নির্মাণ করে সবকিছু ঠিক মত সাজানোর পর ধ্যানের বিশেষ স্তরে অন্তর্গুরুর আগমন ঘটে। অন্তর্গুরু প্রথমে সকল অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য ‘সাইকিক বর্ম প্রদান করেন যা অতীতের সকল অশুভ প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং ভবিষ্যতের এ ধরণের প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখে। অন্তর্গুরুকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যত তীব্র হবে, তত সহজে আপনি তার দর্শন লাভ করবেন।[7]

অন্তর্গুরুর ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

ইসলামের কোন পুরোহিততন্ত্র (Priesthood) নেই – যা এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। পীরের মুরিদ হওয়ার কোন সুযোগ ইসলামে নেই বরং তা যে কিভাবে মানুষকে শিরকের দিকে ডাকে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে তা বোঝা মোটেও কঠিন নয়। কোয়ান্টাম মেথডের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরও ভয়ংকর এই কারণে যে এখানে অন্তর্গুরু কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখেন যা শিরক হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ রাখেনি

কমাণ্ড সেন্টার ও অন্তর্গুরুর নেপথ্যের কাহিনী

কমাণ্ড সেন্টার, অন্তর্গুরু –কোয়ান্টাম মেথডের সাথে জড়িত এই বিষয়গুলোর বাস্তব সংঘটনের কথা তো অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আসলে কিভাবে এগুলো ঘটে তার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে আমাদের জানতে হবে জ্বীনদের সম্পর্কে।

এখানে উল্লেখ্য যে জ্বীনজগতে বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অংশ, কারণ পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বহু জায়গায় এদের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়েছে। অথচ আমরা অনেকেই মুসলিম হওয়া স্বত্ত্বেও জ্বীনের অস্তিত্বের বিষয়টা ভুত-প্রেতের সাথে মিলিয়ে ফেলি এবং এগুলোকেও কুসংস্কার বা অবৈজ্ঞানিক হিসেবে অস্বীকার করে বসি। হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে আমাদের প্রত্যেকের সাথে একজন ক্বারীন জ্বীন আছে যার কাজই হল মানুষকে খারাপ কাজ করতে উৎসাহিত করা। [1]

সার্বক্ষনিক সঙ্গী হবার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেকের ক্বারিন তার জীবনের সব খুটিনাটি সম্পর্কেই জানে। কোয়ান্টামের যারা অনেক উপরের লেভেলে পৌঁছে যান, তাদের অধিকাংশের আসলে জ্বিনদের সাথে যোগাযোগ থাকে। তারা তাদের সাহায্যকারী জ্বিনের মাধ্যমে ব্যক্তির ক্বারিনের সাথে যোগাযোগ করে অতীত বা বর্তমানের তথ্যগুলো সংগ্রহ করে। আর তারপর সেগুলো জানিয়ে ব্যক্তিকে তাক লাগিয়ে দেয়।

জ্বীনরা যেহেতু যে কোনো মানুষের বেশ ধরে আসতে পারে, তাই যাকে অন্তর্গুরু হিসেবে চাওয়া হচ্ছে তার রূপ ধারণ করাও তার জন্য কোনো ব্যাপার না।

কিন্তু এভাবে জ্বীনদের সাথে যোগাযোগ কি ইসলামে অনুমোদিত?

উত্তর হচ্ছে, একদম না। কারণ সুলায়মান (আ:) ব্যতীত আর কোনো মানুষকে মহান আল্লাহতায়ালা জ্বীনদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেননি।[2] তাই মেডিটেশনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার এমন লেভেলে পৌঁছে যাওয়া যায় যে জ্বীনরা পোষ্য হয়ে যায় এমন দাবী করা যাবে না। বরং জ্বীনদের সাথে এইসব ব্যক্তিদের সম্পর্কের স্বরূপ হচ্ছে ‘পারষ্পরিক সমঝোতার’, বলা যায় এক ধরণের চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের শিরকপূর্ণ ও কুফরি কাজ করে।[3] তখন এসব শয়তানের অনুসারী জ্বীনরা তথাকথিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের উপর সন্তুষ্ট হয় এবং বিভিন্ন ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে তাদের সহায়তা করে।

কোয়ান্টামের আরো দিক: মাটির ব্যাংক

কোয়ান্টাম মেথড তাদের শিক্ষার্থীদের যে একটা কাজে খুব বেশী উদ্বুদ্ধ করে তা হল মাটির ব্যাংকে টাকা দান করা। এই টাকা কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের মাধ্যমে নানা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয় বলে দাবী করা হয়। ওদের একটা আলাদা ওয়েবসাইট[4] আছে যেখানে মাটির ব্যাংকে দান করার ফলে কে কি উপকার পেয়েছে সেটার লিস্ট দেয়া আছে। একটি মাত্র ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল-
‘‘২০০৭ সালে আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় জটিলতা দেখা দেয়। অপারেশনের জন্যে সবাই প্রস্তুত। আমার স্বামী মাটির ব্যাংকে কিছু টাকা মানত করলেন। হঠাৎ একজন নার্স অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে আমাকে দেখে বললেন, নরমাল ডেলিভারি হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বভাবিক প্রক্রিয়ায় আমার একটি ফুটফুটে সন্তান হলো। আর্থিক সংকটের কারণে স্বামীর একার পক্ষে সব খরচ বহন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বাচ্চাকে রেখে কাজে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দুজনেই মাটির ব্যাংকে কিছু টাকা দান করলাম। হঠাৎ একটা কোম্পানি থেকে কাজের প্রস্তাব এলো যেখানে বাচ্চাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার ও দেখাশোনার ব্যবস্থা আছে।[5]

মাটির ব্যাংকের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী

আমরা যদি মাটির ব্যাংক সংক্রান্ত সকল উপকারিতার লিস্টগুলো ভালো করে খেয়াল করি, তাহলে দেখবো যে এখানে পরোক্ষভাবে বলা হচ্ছে মাটির ব্যাংকে দান মানুষের কল্যাণ করতে পারে। অথচ ইসলামী শিক্ষা হল কল্যাণ একমাত্র আল্লাহ পাকের কাছ থেকেই আসে, আর কারও জন্য কোন ক্ষতি নির্ধারিত হলে সেটাও একমাত্র আল্লাহ তা’আলার নিয়ন্ত্রণে, আল্লাহর সাথে এতে কোন অংশীদার নেই।
এখানে একটা বিষয় বুঝাটা খুব জরুরী। দান সাদাকা করা ইসলামের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং খুবই পছন্দনীয় ইবাদাত। কিন্তু অন্য সকল ইবাদাতের মতই আমরা এটা করি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য, পরকালে পুরষ্কারের আশায়। অবশ্যই ইসলামের সকল ইবাদাতেরই দুনিয়াবী উপকারিতা আছে- রোযা রাখলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, যাকাত দিলে সম্পদে বরকত আসে…কিন্তু এই আশায় কিন্তু আমরা ইবাদাতগুলো করি না। এখন কেউ যদি ওজন কমানোর জন্য রোযা রাখে, তাহলে অবশ্যই তার নিয়্যত ত্রুটিযুক্ত এবং সে কিন্তু এটার জন্য সওয়াব পাবে না। আমাদের জীবনে যদি কোনো বিপদ আপদ বা ঝামেলা থাকে তাহলে দান করে সেই ইবাদাতের উসীলায় বিপদ থেকে বাঁচার আল্লাহর কাছে দুআ আমরা করতেই পারি, তবে বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে তাহলে দান করবো এমন চিন্তাকে হাদীসে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।[6] তবে এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো যে দান করার মান্নত করলে সেটা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে সেটা খেয়াল রাখা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আমরা এতক্ষণ কোয়ান্টামের ব্যাপারে যা জানলাম তাতে এদের প্রচার ও প্রসারে কি আমাদের অবদান রাখা উচিৎ?

————————————————————————————————————————

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থাবলি
[1] “তোমাদের মাঝে এমন কেউ নেই যার সাথে তার সহচর জ্বীন নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি। তখন সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, “এমনকি আপনাকেও ইয়া আল্লাহর রাসুল (সঃ)? তিনি বলেনঃ আমাকেও। তবে আল্লাহ আমাকে তার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন, এখন সে আমাকে শুধু ভাল করতে বলে।” [মুসলিমঃ ২৮১৪)

[2] রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “একটি শক্তিশালী জ্বিন গতরাত্রে আমার নামায নষ্ট করার জন্য আমার ঔদাস্যের সুযোগ নিতে চাচ্ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ তাকে আমার আয়ত্তে করে দিলেন, সুতরাং আমি তার গলা টিপে ধরলাম। আমি সংকল্প করলাম, মসজিদের খুঁটিসমূহের কোন এক খুঁটিতে তাকে বেঁধে রাখি। যাতে সকালে তোমরা সকলে তাকে দেখতে পাও। অতঃপর আমার ভাই সুলাইমানের দুআ স্মরণ হল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন এক রাজ্য দান কর, যার অধিকারী আমার পরে অন্য কেউ হতে পারবে না।’ (সূরা সাদঃ ৩৫) সুতরাং আল্লাহ তাকে নিকৃষ্ট অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন।” (বুখারী ১২১০, মুসলিম ১২৩৭নং)

[3] যেমন- কুরআনের মুসহাফের উপর বাথরুম করা, সেটা দিয়ে শৌচকাজ করা, অন্য মানুষ বা পশুপাখির রক্ত পান, বিশিষ্ট কোনো মানুষের রক্ত হাজির করা (ফলে তারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, অনেক সময় করে), জ্বীনদের সিজদাহ করা, তাদের কাছে বিপদে আশ্রয় চাওয়া, তাদের নামে প্রাণী উৎসর্গ করা ইত্যাদি।

[4] www.charity.quantummethod.org.bd

[5] www.charity.quantummethod.org.bd

[6] রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মান্নত আদম-সন্তানের জন্য তার তাকদীরের নির্ধারিত বস্তুর অতিরিক্ত কিছু বয়ে আনে না, বরং তার জন্য নির্ধারিত তাকদীরই তার উপর বিজয়ী হয়। অতএব এর দ্বারা কৃপণের কিছু আর্থিক খরচ হয় মাত্র। ফলে ইতোপূর্বে তার জন্য যা সহজ ছিলো না তা তার জন্য সহজ হয়ে গেলো। আল্লাহ্ তা’আলা অবশ্যি বলেছেন, তুমি খরচ করলে আমিও তোমার জন্য খরচ করবো।বুখারী ৬৬০৯, ৬৬৯৪, মুসলিম ১৬৪০
অর্থ্যাৎ এখানে যে মান্নত করছে তাকে কৃপণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এমনিতে সে আল্লাহর পথে দান করতে চায় না, কিন্তু বলে যে আল্লাহ যদি তাকে অমুক দেন তাহলে দান করবে।

শেষ পর্ব

কোয়ান্টামের আরো দিক: কুরআনের মর্ম বাণী

২০১৪ সালের দিকে সম্ভবত কোয়ান্টামের যে প্রধান কর্তা ব্যক্তি- মহাজাতক, ঊনি আল-কুরআনের মর্ম বাণী নামে কুরআনের অনুবাদ নামে বের করেন। ওদের ওয়েবসাইটে গেলে বইটা, ঊনার করা তাফসীরের অডিও ডাউনলোড করা যায়। আমার সেগুলা শোনার সময় বা রুচি কোনোটাই হয় নাই। একজন মানুষ যার ইসলাম সম্পর্কে ব্যাসিক জ্ঞানটুকু নেই, যার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ইসলাম নিয়ে ইচ্ছামত ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে[7] তার করা কুরআনের অনুবাদ কতটুকু বিভ্রান্তিকর হবে তা সহজেই অনুমেয়। আসুন নিচের ছোট্ট উদাহরণটি দেখি:

সূরা বুরুজের (৮৫ নং সূরা) অনুবাদে বুরুজ শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে রাশিমালা। একটা পুরোপুরি ভুল অনুবাদ। কারণ বুরুজ শব্দের প্রকৃত অর্থ বড় তারকা। তবে যে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে জ্যোতিষ শাস্ত্রের মাধ্যমে ভাগ্য গণনার বই পাওয়া যায়[8], সেখানে যে এ ধরনের অনুবাদ করা হবে তা সহজেই অনুমেয়। এরকম আরো অজস্র ভুল ব্যাখ্যা ওদের ওয়েবসাইটেই আছে যেখানে চিন্তা ভাবনা-গবেষণা করা অর্থ্যাৎ আরবী তাফাক্কুর শব্দের অর্থকে ধ্যান হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দাবী করা হচ্ছে কুরআনের বহু জায়গায় নাকি সরাসরি মেডিটেশনের কথা বলা হয়েছে![9]

এই অনুবাদ কিভাবে করেছেন সেটা ঊনি নিজেই বলছেন-

“কোরআন পড়েছি বহুবার। কিন্তু তেমন কিছুই বুঝিনি, ভেতরে ডুব দিতে পারিনি কখনও। যখন এক গভীর মূহূর্তে কোরআনের গভীরে ডুবে গেলাম, আয়াতগুলো যেন কথা বলতে শুরু করলো । শিহরিত, চমকিত হলাম। এক জীবনে যা চাই সবই সাজানো রয়েছে কুরআনে। (পৃ: ২৩)

তাই কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হওয়া স্বত্তেও আল্লাহতে সমর্পিত একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আত্মনিমগ্ন হয়ে ধ্যানের স্তরে তাঁর কালামের মর্মবাণী উপলব্ধি করেছি আর বিস্মিত, চমকিত হয়েছি।” ( পৃ: ২৫)

এখান থেকে এই বই, এই প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির ব্যাপারে আমরা কি উপসংহারে পৌঁছাবো তা ঠিক করার ভার পাঠকের।

ইসলাম নিয়ে টানাহেঁচড়া:

কোয়ান্টাম মেথড বিশ্বাস করে সব ধর্মের মূল বাণী একই।[10] এটা ইসলামের ধারণার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একটু কমন সেন্স খাটালেই আমরা দেখবো যে ইসলামের মূল মেসেজ হল ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে শরীক না করা। হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান এই প্রত্যেকতা ধর্মেই যেখানে আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়েছে সেখানে কিভাবে সব ধর্ম একই হতে পারে?

তাই ধর্ম থেকে যদি অবজেকশন আসে, তাহলে কোয়ান্টামের ব্যাপারে অবজেকশন শুধু ইসলাম ধর্ম থেকেই আসবে। এসব ধ্যান, নির্ভানা এগুলো হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুষঙ্গ। এখন যেহেতু তারা বাংলাদেশে ব্যবসা চালাচ্ছে, ইসলামের সাথে এটার এক ধরণের Compatibility প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ চেষ্টা তাদের মাঝে বিদ্যমান। তাদের ওয়েবসাইটে ‘ধর্মের আলোকে মেডিটেশন’ শিরোনামে লেখায় আমরা সেটা দেখতে পাই যেখানে ইসলাম নিয়ে হাবিজাবি নানা কথা বলা হয়েছে, যেটার ব্যাপারে আমরা অলরেডি আলোকপাত করেছি।

ধ্যান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা নবী রাসূলরা ধ্যান করতেন এমন দাবী করছেন-

ইতিহাসের দিকে তাকান, হযরত ইব্রাহীম (আ) আত্মনিমগ্ন হলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলো-কে আমার স্রষ্টা? একদিন, দুইদিন, তিনদিন, চারদিন পাঁচদিন-তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেলেন এবং সেই নতুন জ্ঞান তাঁর অনুসারীদের মাঝে প্রচার করলেন।
হযরত মুসা (আ) সিনাই পাহাড়ে চলে গেলেন, আত্মনিমগ্ন হলেন। স্রষ্টার সাথে তাঁর কথা হলো। স্রষ্টার বাণী লাভ করলেন এবং সেই বাণী নিয়ে এসে তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্ত করলেন। যিশুখ্রিষ্ট বা হযরত ঈসা (আ) মাঝে মাঝে পাহাড়ে চলে যেতেন। আত্মনিমগ্ন হতেন এবং স্রষ্টার বাণী এনে মানুষের মাঝে, অনুসারীদের মাঝে প্রচার করতেন।[11]

এইসব তথ্য কোন বিশুদ্ধ উৎস থেকে জানা যায় না, তাদের এই দাবীর কোন রেফারেন্স দেয়া নেই।

তাদের একটা খুব কমন যুক্তি হচ্ছে যে রাসূল (সা.) হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যান করতেন। এখানে আমাদের স্পষ্টভাবে জেনে রাখা প্রয়োজন যে

o রাসূল (সা.) হেরা গুহায় ঠিক কি করতেন, যা করতেন সেটাকে ধ্যান বলে আখ্যায়িত করা যায় কিনা এ ব্যাপারে আমাদের কোন বিস্তারিত তথ্য জানা নেই।
o যদি বা তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, রাসূল (সা.) হেরা গুহায় ধ্যান করতেন, তবে তা করতেন নব্যুয়তের আগে। নব্যুয়তের আগে তাঁর করা কোন কাজ আমাদের জন্য শরীয়াতের উৎস নয়। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে ঊনার সাহাবীদের মাঝে এর প্রচলন ছিল না।

কেন ইসলাম নিয়ে টানাহেঁচড়া?

আল্লাহই ভালো জানেন তবে আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের দেশে সঠিক ইসলামী জ্ঞানের চর্চা খুবই কম, আবার মানুষ একটু ধর্ম ভীরু টাইপ। তাই যে কোনো কিছুকে যদি ইসলামী লেবাস ধরে প্যাকেটজাত করা যায় তাহলে ব্যবসাটা ভালো হয়। ওদের ওয়েবসাইটে দেখবেন রামাদ্বান নিয়ে বহু কথা, সাজেশনের মাঝে ধর্ম পালন করতে উৎসাহ দেয়া……এতে সাধারণ মানুষের হৃদয় আর্দ্র হয়, তারা ভাবে আহা ঊনারা তো আল্লাহ রাসূলের পথে চলার কথাই বলছেন। আদতে ঊনারা যা বলছেন সেটা যে কত ভয়ংকর একটা পথ, সেটা বুঝার মত বুদ্ধিবৃত্তিক ম্যাচুরিটি আমাদের দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের নেই।

নামায ও মেডিটেশন কি তুলনাযোগ্য?

যারা মেডিটেশনের পক্ষে এবং বিপক্ষে, উভয় দলই নামাযের সাথে মেডিটেশনের একটা তুলনা করে থাকেন। যারা বলেন মুসলিমদের মেডিটেশনের দরকার নেই, তারা বলেন নামায পড়লেই তো হয়। নামাযই একধরণের মেডিটেশন। এসব কথা বলার আগে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে-

o প্রাথমিকভাবে আমরা নামায পড়ি আল্লাহর আদেশ পালন করতে– পরকালে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে নামাযের ব্যাপারে।
o নামায দ্বীন ইসলামের একটি রুকন।
o নামায কোন শরীর চর্চার পদ্ধতি নয়, যদিও বা তা দৈহিক সুস্থতার জন্য সহায়ক।
অর্থ্যাৎ নামাযের সাথে মেডি্টেশনের মৌলিক পার্থক্য এর উদ্দেশ্য এবং এর উৎসে।

কোয়ান্টামের ওয়েবসাইটে আমরা দেখবো যে নানা চলচ্চিত্র তারকা, গায়িকা এদের কথা বলা হয়েছে যে কোয়ান্টাম করে তারা সুফল পেয়েছেন, তাদের পারফরমেন্স ভালো হচ্ছে। এখন এটা তো কখনো সম্ভব না যে নামায পড়ে কারো এসব হারাম কাজের পারফরসেন্স ভালো হবে। তাই নামাযকে মেডিটেশনের সাথে তুলনা করাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপমানজনক মনে করি।

আর কোয়ান্টামের মানুষজন দাবী করেন-

হুদরিল ক্বালব ছাড়া নামাজ হয় না। শুধু রুকু-সেজদা দিলে নামাজ হয় না, শুধু সূরা-কেরাত পড়লে নামাজ হয় না। নামাজের জন্যে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হুদরিল ক্বালব, একাগ্রচিত্ততা। এই হুদরিল ক্বালব কীভাবে সৃষ্টি করতে হয় তা মেডিটেশনে শিখানো হয়।
এখানে কিন্তু সূক্ষ্মভাবে একটা ভয়ংকর দাবী করা হয়েছে। সালাত In its original form, যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন, আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি নিতে পারে না, আমাদের ‘অতিরিক্ত’ কিছু দরকার। আমরা যদি একটু পড়াশোনা করি, তাহলে বুঝবো যে এটাই exactly বিদআতের সংজ্ঞা। বিদআত চেনার জন্য নিচের ধাপগুলো খুব সাহায্য করে আমাকে-

o প্রথমেই দেখতে হবে তা ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা। হতে পারে তা কোন কথা, কাজ বা বিশ্বাস।
o ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে দেখতে হবে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা এই পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন কিনা।
o যদি না জেনে থাকেন, তবে তাঁর উৎস ওহী নয়। আর ইসলামে সকল ইবাদাতের উৎস একমাত্র ওহী।
o যদি জেনে থাকেন, তবে তাঁরা তার উপর আমল করেছিলেন কিনা। যদি না করে থাকেন, তবে সেটাই উচিত সিদ্ধান্ত, কারণ তাঁরাই শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম এবং আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ।

কেন মেডিটেশন আমাদের দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে?

একথা অনস্বীকার্য যে ইসলাম পালনের ফলে যে শান্তি আমাদের জীবনে অবধারিতভাবে আসার কথা ছিলো, আমরা অনেকেই সেটার স্বাদ পাই নি। আমাদের মাঝে যে শূন্যতা বিরাজ করছে, সেটা পূরণ করার আশ্বাস দিয়েই কোয়ান্টাম আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের মত ব্যবসা করতে পারছে।

কিন্তু কেন এই শূন্যতা?

কারণ খুব সহজ। আমরা জানিনা আমরা নামাযে কী পড়ি। আমরা আল্লাহর কাছে কাঁদতে, ঊনার সাথে কথা বলতে জানি না, আমরা জানিনা আসলে ইসলাম আমাদেরকে কিসের পথে ডাকে। যারা দাবী করেন তারা কোয়ান্টামের মাধ্যমে নেশা ছাড়তে পেরেছেন, রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন, যা কিছু ইতিবাচক তাদের এখানে শেখানো হয়, এর প্রত্যেকটি অর্জন করার নিজস্ব, আরো ফলপ্রসূ মেকানিজম ইসলামে আছে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর যে কথা বলতে বলতে ওরা গলা ফাটিয়ে ফেলে, তা ইসলামের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। আমি এমন হাজারটা উদাহরণ দিতে পারবো, কিন্তু তাতে এই লেখার কলেবর আরো বেড়ে যাবে যেটা কাম্য নয়।

আলোচনার সারাংশ

মেডিটেশনের একাধিক ধাপ আছে। প্রথম ধাপে যা বলা হয়, করা হয়, তাতে শিরক সূক্ষ্মভাবে লুকিয়ে আছে যখন দাবী করা হয় যে মানুষের মনই সকল ক্ষমতার উৎস। সেগুলো বাদ দিয়ে, এমনি ব্যায়াম বা অন্যান্য মোটিভেশনাল টেকনিক, অ্যাপ্রোচের মত মেডিটেশনের কিছু সুফলের কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হয় পরের ধাপ গুলোতে যখন কমাণ্ড সেন্টার, অন্তর্গুরু এসব কন্সেপ্ট সামনে আসে, এগুলোতে শিরকের উপস্থিতি আর সূক্ষ্ম নেই, স্পষ্ট হয়ে গেছে।

শেষ কথা-আমাদের করণীয়

এক কথায় যদি আমাদের করণীয় বলতে হয়, তবে তা হল দ্বীন শিক্ষা করা। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে দ্বীন শিক্ষার রাস্তা কোন কালেই মসৃণ ছিলনা। তাবে-তাবেঈদের মত আমাদের হয়তোবা হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই করতে উটের পিঠে চড়ে মাসের পর মাস ভ্রমণ করতে হবে না, তবে আজকের অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে Click করে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করার আগে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে উৎসটা সহীহ কিনা। আলেমের অধীনে Systematic উপায়ে দ্বীন শিক্ষার কোন বিকল্প কখনও ছিলনা, এখনও নেই। আমাদের নিজেদের আরবী শিখতে হবে, বাচ্চাদের শিখাতে হবে, নিদেন পক্ষে জানতে হবে যে কুরআনে, সালাতে আমরা কী বলছি। আর তাহলেই ইসলামের মোড়কে উপস্থাপিত কোনো কিছু আমাদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না ইনশাল্লাহ।

————————————————————————————————————————

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থাবলি

[7] হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে নবীজী (স) বলেছেন: সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। ( মেশকাত) ।এই হাদীসটিকে স্কলাররা জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। www.quantum.quantummethod.org.bd
[8] www.publication.quantummethod.org.bd
[9] www.quantum.quantummethod.org.bd
[10] www.quantum.quantummethod.org.bd
[11] এগুলো আগে কোয়ান্টামের ওয়েবসাইটে হাজারো প্রশ্নের জবার শিরোনামে ছিলো। এখন ওয়েবসাইটটি নতুন করে সাজানো হয়েছে, সেখানে হাজারো প্রশ্নের জবাব নামে ৩টা বই ডাউনলোড করা যায়। ৩টা বই এর কোন পার্টে এটা এখন আছে সেটা বের করার সুযোগ লেখকের হয়নি কারণ তাহলে ৩টা বই পুরোটা পড়তে হবে যেটা স্রেফ সময় নষ্ট বলে তিনি মনে করেন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন