পঙ্কিল পথ থেকে ফিরে আসার কাহিনী; কিছু শিক্ষা।

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

পর্ব ১

কিছুটা হঠাৎ করেই ভিডিওটার চুম্বক অংশ আমার চোখে পড়ে। জানি না কেন ভিডিওটা আমাকে খুব টাচ করেছিলো। আমি মেয়েটাকে নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করলাম। জানার পর আমার প্রতিক্রিয়া এতটাই গভীর ছিলো যে এটা নিয়ে লেখার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। একবার ভেবেছিলাম লেখাটার শিরোনাম দিবো ‘একজন পর্ন স্টারকে নিয়ে জানা’। তারপর ভাবলাম নাহ, তাহলে প্রথমত মেয়েটা যে গভীর স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে গেছে সেটাকে অসম্মান করা হবে, দ্বিতীয়ত পর্নোগ্রাফী যে একটা স্টার হওয়ার মত বিষয় সেটাকে পরোক্ষ ভাবে স্বীকার করে নেয়া হবে।

হুম, পর্ণগ্রাফির সাথে জড়িত ছিলো এমন একজন মেয়েকে নিয়েই এই লেখা। সঙ্গত কারণেই তার নাম উল্লেখ করছি না। মেয়েটার নাম জেনে আমাদের বিশেষ কোনো ফায়দা নেই। কিন্তু তার কাহিনী থেকে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয় আছে যেটা আমাদের আজকের এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য। আর এই স্টাইলটা মূলত কুরআনের স্টাইল, কুরআন আমাদেরকে অধিকাংশ চরিত্রেরই নাম, জায়গা এসব জানায় না, ঘটনা থেকে শিক্ষাটাকে ফোকাস করে।

মেয়েটা সপরিবারে USA তে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আসে ৯/১১ এর ঘটনার সমসাময়িক সময়ে। স্কুলে গিয়ে সে খুব নিষ্ঠুরভাবে Bulling এর স্বীকার হয় যার থিম ছিলো Fat and Terrorist. মোটা হিসেবে খুবই লাঞ্চনার স্বীকার হত সে। নতুন দেশ, নতুন সমাজ হওয়ার কারণে তার বাবা-মা অনেক আগলে রাখত, এইসব কথা ignore করার ক্ষমতা তার ছিলো না, নিজের ব্যাপারে খুব নিচু ধারণা তৈরি হয় তার। কলেজে উঠার পর কিছুটা মরিয়া হয়ে সে ৫০ পাউণ্ড ওজন কমিয়ে ফেলে। কিন্তু তারপর সে খেয়াল করে যে এতে তার শরীরের একটা বিশেষ অংশ প্রায় নাই হয়ে গেছে। তখন সে ব্রেস্ট সাপ্লিমেন্ট সার্জারী করায়। আর এরপরেই সে তার আশেপাশে দেখতে পায় আমূল পরিবর্তন! কী সেটা?

আশে পাশের ছেলেরা তাকে খুব চাচ্ছে, তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে। হঠাৎ এই স্তুতি বাক্যের বন্যায় ভেসে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মত তার নিজেকে খুব দামী কেউ মনে হতে থাকে। তার মনে হয় এই যে Praise, self validation………এটা সে কিছুতেই হারাতে পারবে না, সেজন্য তাকে যা কিছুই করতে হয় সে প্রস্তুত।
এই চিন্তা থেকেই সে তার জীবনের সবচেয়ে ভুলটা করে বসে। একদিন এক লোক তার হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল যে সে দেখতে দুর্দান্ত সুন্দরী, তার কোম্পানির জন্য মডেল হবে কিনা। বাসায় ফিরে গুগল করে ও দেখল যে এটা একটা পর্ন কোম্পানি। প্রথমে ধাক্কা খেলেও, সে অফারটা একেবারে উড়িয়ে দিলো না কারণ এই লোক তাকে সুন্দর বলেছে। তাছাড়া যে তীব্র রক্ষণশীল পরিবার থেকে সে এসেছে, সেটার প্রতি এক ধরণের বিদ্রোহ করার নেশাও তাকে পেয়ে বসেছিলো।

সপ্তাহ দুয়েক পরে সে তাদের অফিসে গিয়ে দেখতে রাজি হয়। গিয়ে অভিভূত হয়ে যায়……দারুণ বিলাসী কম্পার্টমেন্ট, সবাই খুব আন্তরিক, সবাই ওকে দারুণ প্রশংসা করছে। অনেক মেয়েরাও কাজ করছে, সে এক ধরণের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। কিছুটা মোহাবিষ্ট হয়ে ও কন্ট্রাক্ট সাইন করে ফেলে, ওর ধারণা ছিলো যে কেউ এটার ব্যাপারে কিছু জানবে না, একটা ফান টাইপ কিছু হবে। It will remain a dirty little secret of her.

প্রথম দৃশ্যায়নের পর তার মনের ভেতর এসেছিল যে এটা ভালো কিছু হচ্ছে না। কিন্তু ওকে খুবই তোষামোদ করা হচ্ছিল। মেকআপ, আউটফিট চুজ করা ইত্যাদি সব কিছু ওকে ঘিরেই ছিল। এখানে যেহেতু সে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, তাই তার অপরাধবোধের মনোভাব টেকেনি। এরপর সে একটা দৃশ্য করল যেখানে সে হিজাব পড়ে এসেছিল। এটাই বিশ্বব্যাপী নিউজ হয়ে যায়। বিভিন্ন পর্ন সাইটগুলোতে সে টপ রেটেড অবস্থানে চলে যায়। যদিও সে এটা করতে চায় নি, কিন্তু তার অনিচ্ছার ব্যাপারটা নিয়ে সবাই এমন হাসাহাসি করেছিলো যে সে আর কথা বাড়ায় নি, তার সেই আত্মবিশ্বাস বা সৎ সাহস আর অবশিষ্ট ছিলো না।

মেয়েটি এই পর্ণ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছে মাত্র তিন মাস, বারোটা দৃশ্যে, যেখান থেকে ওর আয় ছিলো স্রেফ $১২০০০, যদিও ওর ভিডিও থেকে পর্ন কোম্পানিটি আয় করছিলো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার!

মেয়েটার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় শুরু হয় এই কাজ ছেড়ে দেয়ার পর। হিজাব পরা দৃশ্যের পরপরই মূলত সবাই তাকে চিনে যায়। দেশ থেকে কিছু বন্ধুরা জেনে ফেলে এটা সে। জানার পর তার পরিবার তাকে ত্যাজ্য করে।

এই সময়টাতে সে যেখানেই যেত, মানুষ ওকে চিনে ফেলতো। এহেন পরিস্থিতিতে সে নিজের আসল চেহারা লুকাতে গেট আপ, চুলের রঙ পরিবর্তন করে ফেলে, তারপরও অপরিচিত মানুষরা ওকে চিনে ফেলত। এটা থেকে বোঝা যায় যে অধিকাংশ মানুষ পর্ন সাইটের কন্টেন্টের ব্যাপারে কতটা অবগত! মানুষ যেভাবে ওর দিকে তাকাত তাতে ওর মনে হতো তারা ওর কাপড় ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে মানুষ ওকে জনসম্মুখেই ছুঁতে চাইত, কারণ তারা মনে করত যেহেতু ও পর্নে অভিনয় করেছে ও এমনই। যেহেতু সে ক্যামেরার সামনে নগ্ন হতে পেরেছে, শারীরিকভাবে তার গোপনীয়তা লঙ্ঘন করলে সে কিছু মনে করবে না।

এসময় ও একজনের সাথে সম্পর্কে জড়ায়, যেটা খুবই অস্বাস্থ্যকর একটা সম্পর্ক ছিল, কারণ গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য সে পুরোপুরি তার বয় ফ্রেণ্ডের ওপর নির্ভর করত। ছেলেটি যেদিন ওকে সুন্দর লাগছে বলত না সেদিন ওর দিনটাই খারাপ যেত।

এভাবে চলতে চলতে একসময় মেয়েটির মাঝে একটা পরিবর্তন আসে। কী সেই পরিবর্তন?

পর্ব ২

মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয় যে তার সাথে যা ঘটছে এই সব কিছু মেনে নিবে, নতুন করে শুরু করবে সব কিছু। এ ব্যাপারে সে একজন থেরাপিস্টের সাহায্য নেয়। তার ভাষ্যমতে, তার কাউকে দরকার ছিল এখন সে কী করবে এটা বলে দেয়ার জন্য। অথচ চিন্তা করুন এই মেয়েটিই এই অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছিলো রক্ষণশীল পরিবারের খালি এটা করো না, ওটা করোনা এই নানা বাঁধা নিষেধের চাপে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো বলে! What an irony!

থেরাপিস্টের সাথে প্রথম সেশনেজানতে চাওয়া হয় তার জীবনের লক্ষ্য। সে বলে সে চায় কেউ তাকে পর্নস্টার না বলুক, তার পরিচিতি একে ছাপিয়ে যাক। থেরাপিস্ট প্রথমেই ওকে বলে বয় ফ্রেণ্ডের সাথে সম্পর্কটা থেকে বের হয়ে আসতে। মেয়েটা তাই করে। সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এবং সে উপলব্ধি করে এই প্রথম সপ্তাহটা ছিল ওর জন্য খুবই Empowering। কারণ বয়ফ্রেন্ড আজকে ওকে ফোন দিবে কিনা, দেখা করবে কিনা এইসব চিন্তা নিয়ে সারাক্ষণ থাকতে হয়নি। ও যেন একটা অদৃশ্য বলয় থেকে মুক্তি পেয়েছিলো।

এরপর কয়েকমাস ও Gratitude Diary লিখত। নিজের সম্পর্কে নতুন জানল এমন তিনটা জিনিস লিখে রাখত প্রতিদিন। এইসময় মেয়েটি ভেবে দেখে যে পুরুষদের থেকে সে যত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সে সবকিছুই ছিল ক্ষণস্থায়ী। বরং সে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা অনুভব করেছে যখন তার কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল না, কারো সাথে কথাবার্তা বলত না এবং সময় দিয়েছে মানুষ হিসাবে নিজেকে, নিজের প্যাশন সম্পর্কে জানতে।ফলে একজন পুরুষের মাঝে সে কী চায় আর কী চায়না তা বোঝার সুযোগ পেয়েছে। সে মনে করে সব মানুষেরই, বিশেষ করে মেয়েদের এমন সময় কাটানো উচিত যখন সে সিঙ্গেল, বয়ফ্রেন্ডকেন্দ্রিক না।

কিন্তু তারপরও ওর একটা অহর্নিশ চিন্তার কারণ ছিলো যে এমন কাউকে ও জীবনে পাবে কিনা যে ওকে চেনে না বা চিনলেও ওর অতীত নিয়ে পড়ে থাকবে না। থেরাপিস্ট ওকে তখন এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বলেছিল।

মেয়েটি ভেবেছিল তার অতীত নিয়ে কোন কথা না হলে হয়ত মানুষ একসময় তা ভুলে যাবে। তাই সে অনেক ক্ষ্যাত ধরণের পোশাক পড়া শুরু করল, জনসম্মুখে যাওয়া একদম কমিয়ে দিল। কিন্তু সে আসলে ভুল ভেবেছিলো। আজকের ইন্টারনেটের যুগে সে ছিলো Just one click away। এখানে কোনো কিছু স্মৃতি থেকে হারায় না। এমনকি পরে যখন সে নিজের জন্য একটা স্পোর্টস ক্যারিয়ার বেছে নিল, যা ছিলো তার প্যাশন, তখনও একটা রেডিও শোতে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল পর্নস্টার হিসাবে। এতে সে মারাত্মকভাবে রিঅ্যাক্ট করে। তখনই তার থেরাপিস্ট তাকে পরামর্শ দেয় তার এই অতীত নিয়ে কথা বলার জন্য। থেরাপিস্টের এই সাজেশনটা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। আসলে আমরা যদি আমাদের জীবনের গল্প নিজেরা না বলি, তাহলে মানুষ তাদের ইচ্ছামত Narrative বলে বেড়াবে যেটা হবে আন্দাজ ও কল্পনার একটা মিশ্রণ। মেয়েটার যে ভিডিওটা আমি দেখেছি, সেটা আসলে থেরাপিস্টের এই পরামর্শেরই ফল, সে পাব্লিকলি এগুলো নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে।

মেয়েটা তার অতীত নিয়ে খোলামেলা কথা বলার পর ওর কাছে অনেক ই-মেইল আসা শুরু করে যেখানে পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা মেয়েরা তাকে জানায় যে তারা নানাভাবে শোষণের স্বীকার হচ্ছে। তাদের অনেক সময় এমন সব কাজ করতে বাধ্য করা হয় যা তারা করতে চায় না, বা কাজ নেয়ার সময় হয়ত তারা কন্ট্রাক্টের পরিভাষা বুঝতে পারেনি বলে রাজি হয়েছে ইত্যাদি। এসব ই-মেইল পেয়ে মেয়েটির মনে হয় সবার সামনে এই নিয়ে কথা বলে ও ভালোই করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মেয়েটার এসব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কি লাভ? আমরা যারা সো কল্ড প্র্যাক্টিসিং, তাদের জন্য এসব মেয়েরাতো রীতিমত অচ্ছ্যুত টাইপ। কিন্তু মেয়েটার ভিডিওটা দেখার পর একটা প্রশ্ন আমাকে খুব তাড়িত করে বেড়াচ্ছিলো- একটা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে যে পর্ণ মডেল হয়ে উঠলো এটা কি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি আমরা নিজেদের অজান্তে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি এই পংকিল পথে?

আমার কাছে মনে হয়েছে যে মেয়েটি আমাদের সমাজের মেয়েদের একটা বিশাল অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যাদের কাছে বাইরের সৌন্দর্যটাই আসল। কারো গায়ের রঙ (এটা অবশ্য অনেক পুরনো সমস্যা), উচ্চতা, শারীরিক গঠন, চুল ইত্যাদি যথেষ্ট আকর্ষণীয় না হলে তাকে এই নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। বলা যায় অন্যরা তাকে ভুগতে বাধ্য করে। অথচ মানুষ মাত্রই স্বীকৃতি চায়। কমবয়সী মেয়েরা তখন স্বপ্ন দেখতে থাকে একজন প্রিন্স চার্মিং এর যে তাকে ভালোবাসবে নিঃশর্তভাবে, সকল বাঁধা, পরিবারের অমত অগ্রাহ্য করে তাদের বিয়ে করবে। তাই আজকালকার মেয়েরা মরিয়া হয়ে যায় একজন বয়ফ্রেন্ড যোগাড় করার জন্য। আমার এক বান্ধবীর কাছে শুনেছি তার ছোট বোন মনে করে কারো বয়ফ্রেন্ড নেই মানে তার বুঝি কোন সমস্যা আছে! কোনোমতে একটা সম্পর্কে জড়ানোর পর নিজের ন্যুড পিকচার দিয়ে হলেও বা শারীরিক সম্পর্ক করে হলেও বা নানা ধরণের অ্যাবিউজ স্বীকার হয়ে হলেও তারা তাদের বয়ফ্রেণ্ডকে ধরে রাখতে চায়। যদি একান্তই সম্পর্ক না টেকে তাহলে অসস্থির হয়ে যায় আর একটি সম্পর্কে জড়ানোর জন্য।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আবোল তাবোল বলছি? উহু, একটু চোখ কান খোলা রেখে
আপনি যদি যে কোনো পত্রিকা বা অনলাইন পোর্টালের পোস্টগুলো পড়েন,যেখানে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা তাদের সমস্যা শেয়ার করে, আপনি অধিকাংশগুলো প্রশ্নগুলোই দেখবেন বয়ফ্রেণ্ড কেন্দ্রিক। বয়ফ্রেণ্ডের সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেছে, তারপর ছেড়ে চলে গেছে, এখন আমি কি করবো, আমার বয়ফ্রেণ্ড হুমকি দিচ্ছে শারীরিক সম্পর্ক না করলে ছেড়ে চলে যাবে, ন্যুড ছবি না পাঠালে ছেড়ে চলে যাবে ইত্যাদি।

এগুলো পড়লে কেন যেন আমার হাপুস নয়নে কানতে ইচ্ছা করে। কেন একটা মেয়ে এতটা হ্যাংলা হয়ে যাবে? কেন একটা মেয়ের ন্যুনতম আত্মসম্মানবোধ থাকবে না?

তখন আমি নিজেকে প্রশ্ন করি যে আচ্ছা আমরা মা-বাবারাই কি এমন মানসিকতা সৃষ্টিতে পরোক্ষভাবে প্রধান ভূমিকা পালন করি? আমরা বড়রা যখন কাউকে দেখি, নতুন বউ বা এমনি ই মানুষ, সবার আগে তার ড্রেস-পোশাক, শারীরিক সৌন্দর্য দিয়ে তাকে যাচাই করি? আমরা কি আমাদের মেয়ে বাচ্চাদের এমন বলি যে এটা করো না, সেটা করো না, তাহলে তোমার বিয়ে হবে না? কালো, খাটো মেয়ের বাবারা কি মেয়েদের সামনেই শোনে যে এই মেয়েকে পার করতে তো তোমার খবর হয়ে যাবে? আমরা কি আমাদের দুই মেয়ে সন্তানের মাঝে যে কম সুন্দর তাকে হেলাফেলা করি? যে কম সুন্দর তাকে বলি পড়াশুনার দিকে বেশী মনোযোগ দাও? আমাদের যে মেয়েটি সুন্দর তাকে কি আমরা সবসময় বেশী আদর করি? আমরা নিজেরা কি মানুষকে নিয়ে হাসাহাসি করি, আমরা নিজেরা কি অন্যকে উপহাস না করার যে নির্দেশ আল্লাহ সূরা হুজুরাতে আমাদেরকে দিয়েছেন সেটা মেনে চলি? বাচ্চাদের শিখাই?

আমরা বড়রা যখন একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে পার করে দেয়াকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করি তখন এটা কি টের পাই যে তারা সেটাকে Translate করে একজন বয়ফ্রেণ্ড পাওয়ার যোগ্যতা আছে কী না এটাতে?

আচ্ছা আমরা কি আমাদের মেয়েদের জীবনের উদ্দেশ্য শিখাই? তাকে কখনো বলি যে তোমার রূপ ছাড়িয়েও তুমি একজন মানুষ, যার মেধা আছে, বিবেক আছে, সমাজের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা আছে?

আচ্ছা এটা শিখানোর মুখ কি আমাদের আছে? আমাদের নিজেদের জীবনেরই কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা আর স্ট্যাটাস সিম্বল ধরে রাখা ছাড়া?

শেষ পর্ব

আমার এক বাল্যবন্ধুর সাথে সেদিন কথা হচ্ছিলো, কথায় কথায় চলে এলো জীবনে করা ভুলগুলোর কথা। সে বলে ফেললো যে এখন ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে যে কিভাবে আমি তখন এমন একটা অমানুষের সাথে ৬টা বছর প্রেম করেছিলাম! আমি শুনে চুপ করে ছিলাম। আমি যে জানি কারণটা কী ছিলো ! সেই ছেলে প্রথম জীবনে তাকে সুন্দর বলেছিলো! ছোটবেলা থেকেই সে সুন্দর না এটা এতবার শুনেছে যে একটা সম্পর্কে জড়ানোর জন্য একটা বিষয়ই যথেষ্ট ছিলো-তার রূপের স্বীকৃতি।

এটাই আসলে আমি এতক্ষণ বুঝাতে চেয়েছি। স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা মানুষকে ঠিক কিসের দিকে ঠেলে দিতে পারে সেটা কি আমরা বুঝি? আমি ব্যক্তিগতভাবে ছেলেরা যেন আমার দিকে আকৃষ্ট না হয় বা ছেলেরা যেন উত্যক্ত না করে এই কারণ দেখিয়ে মেয়েদের পর্দা করানোর খুবই বিরোধী। আমি মনে করি এতে মেয়েরা দুনিয়ার কারণে ইবাদাত করতে শিখবে। কিন্তু ভিডিওটা দেখে মেয়েটার কাহিনী জানার পর আমার কাছে মনে হয়েছে যে ইসলামের পর্দা প্রথা আসলে একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে মেয়েদের শারীরিক গঠন নিয়ে বিপরীত লিঙ্গের সপ্রশংস দৃষ্টি পাওয়ার প্রতিযোগীতার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ছেলেরা তো আমাকে দেখতেই পাবে না ওইভাবে তাহলে তোমাকে এমন লাগছে তেমন লাগছে এটা বলে পটানোর, অন্যায় আচরণ করার সুযোগই তো পাবে না!

মা-বাবা হিসেবে আমাদের সন্তানদের বুঝানো উচিৎ যে শারীরিক সৌন্দর্যের ভিত্তিতে মানুষের কাছ থেকে গ্রহনযোগ্যতা পেতে চাওয়ার মানসিকতা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মূলত, গোটা মানবজাতির জন্যই ক্ষতিকর। কারণ এটা ক্ষণস্থায়ী এবং অনেক সময়ই আমাদের সাধ্যের বাইরের বিষয়।

তবে হ্যাঁ, আমরা যখন আমাদের মেয়েদের পর্দা করতে বা প্রেম না করতে নিষেধ করবো তখন যেন আমরা হারাম পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হই। আমরা যেন শুধু কোনটা হারাম আর কোনটা হারাম না এটার লিস্ট তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ না করি। ইন্টারভিউতে মেয়েটা যখন বলেছিলো যে একটা বিদ্রোহ করার প্রবণতা তার মাঝে কাজ করেছে তখন আমার মনে হয়েছে আমি যেন আমার কৈশোরের আমিকে দেখতে পাচ্ছি। আমার আব্বা খুব কড়া ভাবে নিষেধ করতেন তসলিমা নাসরিনের বই পড়তে। কিন্তু কেন নিষেধ তা আমাকে কোনো দিনও ঠাণ্ডা মাথায় বুঝায় বলা হয় নাই। ফলাফল? নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সহজাত আকর্ষণ হিসেবে তার সবগুলো বই আমি গিলেছি। এখন মা হওয়ার পর আমি কি চাবো আমার মেয়ে এই ধরণের বইগুলো পড়ুক? উত্তর হচ্ছে না। কিন্তু আমি কি তাকে এসব কিছু পড়তে না করবো? সেটার উত্তরও না। আমি চাই আমার মেয়ে বুঝুক যে এই জিনিসগুলো কেন ক্ষতিকর। ভালো ও মন্দের বোধ এমনভাবে তৈরি হোক যাতে আমি যখন তার সাথে বিষয়গুলো আলোচনা করে তাকে গাইড করার জন্য বেঁচে থাকবো না তখনও সে নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো ঠিকভাবে নিতে পারবে ইনশাল্লাহ।

এই প্রক্রিয়ায় কি সে ভুল করবে বা করতে পারে? হুম। মানুষ আসলে অনেক সময়ই ঠেকে শেখে। কিছু জিনিস হাজার বার বলেও হয় না। বাচ্চাদের মাঝে মাঝে ভুল করতে দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। Over protective হতে চাই না বাচ্চাদের ব্যাপারে। যদি ভুল করেও ফেলে তাহলে সে যেন জানে যে আমার দরজা তার জন্য খোলা আছে ইনশাল্লাহ। কেন এটা বলছি?

ভিডিওতে মেয়েটা যখন তার পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির কাজ ছেড়ে দেয়ার পরের সময়ের কথা বলছিলো তখন ওর বলা দুইটা কথা আমাকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিলো- I understood some mistakes are unforgivable আর I was alone even after leaving the industry. সত্যি কী নিষ্ঠুর এই অনলাইন জগত। এ যেন আরেক আমলনামা যেখান থেকে কিছু মুছে ফেলা যায় না, চাইলেই কারো কোনো ভুল কাজ/ কথা এগুলোর স্ক্রিন শট নিয়ে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া যায় কিংবা ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাক মেইল করা যায়।

আমি জানি না কেন, কিন্তু ইন্টারভিউ এর এই অংশে এসে আমার মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করেছে। আমার মনে হয়েছে মেয়েটাকে বলি যে মানুষের দরবারে কিছু ভুল অমার্জনীয় হলেও আল্লাহর দরবারে এমন কোনো গুনাহ নেই যা তওবার মাধ্যমে মুছে ফেলা যায় না!

আচ্ছা আমাদের কি যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম সাইকোলোজিস্ট আছেন যারা Coping Mechanism হিসেবে আল্লাহকে সমীকরণের মাঝে নিয়ে আসবেন? এ কথা বলার কারণ হচ্ছে যে থেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে মেয়েটি নতুন করে জীবন শুরু করতে পেরেছে, সে তাকে বয়ফ্রেণ্ডের উপর নির্ভর না থেকে নিজেকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আমার কেন যেন মনে হয়েছে এক ইলাহ থেকে আরেক ইলাহর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! তাই সব কিছুর পরও এমন কোনো ছেলে পাবে নাকি যে তার অতীত নিয়ে মাথা ঘামাবে না এই চিন্তা তাকে কুঁকড়ে খেয়েছে, এমন কাউকে পাওয়ার মাধ্যমে সে এখন জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সার্থকতা কি এখানে? এই সম্পর্কটা যদি না টেকে তাহলে সে কি আবার খেই হারিয়ে ফেলবে জীবনের? আল্লাহই ভালো জানেন।

আমার বিশ্বাস মা-বাবা হিসেবে আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার আমাদের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েগুলো কী ভাবছে, কী নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখছে। তাদের মনোজগতের নাগাল পাওয়াটা আমাদের খুবই জরুরী। বয়ঃ সন্ধির বয়সটা খুব ভুল করার বয়স। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণটা সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এটাকে জোর করে না দমিয়ে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা শিখাতে হবে, আর সেটা করতে হবে আদর করে, ভালোবাসা দিয়ে।বিনোদনের, পর্নের রুপালী জগতটা যে কতটা বিভ্রান্তিকর সেটা আমাদের বুঝাতে হবে। যারা মেয়েটির উলটা পালটা ছবি দেখে আকৃষ্ট হয়েছে তারা কি জানে যে তার শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটা কৃত্তিমভাবে বৃদ্ধি করা? আমি ঠিক জানি না কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়েছে মা-বাবাদের মাঝে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা আরো বহুল প্রচলিত করা উচিৎ। শরীরের এই অংশের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গী একটু বদলানো দরকার- এখানে যে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রিযিক আছে! এটা তো শুধুই আদিম চাহিদা মিটানোর যন্ত্র নয়!

ইন্টারভিউ এর শেষে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আজকের তোমাকে যদি ওই লোকটি সুন্দর বলে পর্নের মডেল হওয়ার অফার দিতো তাহলে তুমি কি করতা? সে উত্তর দিয়েছিলো- ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ছুরি নিয়ে ঘুরতাম আর সেটা ব্যবহার করে দৌঁড়ে পালাতাম সেখান থেকে।

আমাদের সবার জীবনেই হয়তো এমন ভুল থাকে যেখান থেকে আজকের আমাদের দৌঁড়ে পালাতে ইচ্ছা করে। আমাদের সন্তানরা যেন এমন ভয়ংকর কোনো ভুল করার পর ঠেকে না শিখে, সেটার জন্য আল্লাহর শিখানো দুআ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই আসলে-

হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্বামী/স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং তাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর। (২৫ঃ৭৪)

আল্লাহ আমাদেরকে চক্ষু শীতলকারী সঙ্গী এবং সন্তান দান করুন, আমাদের বাচ্চাগুলোকে ঠিকঠাক ভাবে লালন পালনের তৌফিক্ব দেন।


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন