রাত প্রায় ৩টা। দুই বছরের আবরারের জ্বর কিছুতেই কমছে না। গত পাচঁ দিন ধরে ছেলেটা জ্বরে ভুগছে, ডাক্তার দেখেছে কিন্তু ঔষধেও কোনো কাজ হচ্ছে না। মিলির মনটা ছটফট করছে। কি যে হলো ছেলেটার!! কঠিন কোনো অসুখ হলো নাতো —- মাথার মধ্যে এই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে মিলির।
হঠাৎ করেই মনে হলো, মহান রবের সাথে একান্তে কথা বলা দরকার ওর !! তাড়াতাড়ি অজু করে এসে সালাতে দাঁড়িয়ে গেল মিলি। দু’রাকাত সালাত আদায় করলো। তারপর দু হাত তুলে চোখ বন্ধ করে একাগ্র চিত্তে রবের কাছে বলতে লাগলো—“মহান রব্বুল আলামীন ,তোমার আরেক ছোট্ট বান্দাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দাও।”
রবের প্রশংসা ও গুণাবলি উচ্চারণ করে দু’আ করতে লাগলো মিলি। বান্দার কাছে করা রবের প্রতিশ্রুতি গুলো স্মরণ করে তাঁর কাছে সন্তানের সুস্থতা ভিক্ষা চাইল । বিনীত চিত্তে, অশ্রুসজল চোখে তাঁর মনের ব্যকুলতা প্রকাশ করলো।
একপর্যায়ে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো মিলির। মনে হলো স্বয়ং স্রষ্টা যেন প্রথম আকাশে নেমে এসে এক অসহায় মায়ের আকুতিগুলো শুনে নিলেন। এরপর এক অজানা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল মিলির অন্তর। যাক, যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন পৌঁছে গেছে, এখন শুধু কবুল হওয়ার অপেক্ষা!!
এরই মধ্যে ফাজর এর সময় হয়ে যায়। চারপাশ আজান এর সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে। মিলি ফজরের সালাত আদায় করল। এরপর ছেলের পাশে শুয়ে সূরা ফাতিহা, সূরা নাস, সূরা ফালাক, সূরা ইখলাস,আয়তুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিতে থাকে।
রাতের অাঁধার ভেদ করে সকালের সূর্যটা যখন রক্তিম আভা নিয়ে জেগে উঠছে তখন মিলি ছেলের কপালে হাত রেখে বুঝতে পারে জ্বরের তীব্রতা অনেক কমে এসেছে। মিলি নিশ্চিন্ত হলো, আল্লাহ তাহলে ওর দুআ কবুল করেছেন। চোখ দুটো বন্ধ করে কৃতজ্ঞ চিত্তে বলে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ !!
পঁচিশ বছর পর………
.
পনের দিন যাবৎ আই সি ইউ তে অচেতন অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে আছে মিলি। রান্নাঘরে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। আবরার সাথে সাথেই মাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই কয়দিনে মিলির জ্ঞান তো ফেরেইনি বরং সব রকম পরীক্ষা করেও ডাক্তাররা বুঝতে পারছেন না মিলির ঠিক কি হয়েছে!!
হাসপাতালের করিডোরে অসহায়ভাবে পায়চারি করছিল আবরার। এমন সময় ড্রাইভার সোহেলের ফোন বেজে উঠল। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়ি গিয়েছিল সোহেল।
“তোমার আম্মা কেমন আছেন সোহেল?” আবরার একথা জিজ্ঞেস করতেই সোহেল হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল “স্যার, ডাক্তার কইছে আম্মার হাতে টিউমার হইছে। এখনই অপারেশন না করাইলে পরে হাত কাইটা ফেলতে হইতে পারে। কি করুম বুঝতাছি না। আমারতো এতো টাকা নাই স্যার” !!
সোহেলের অসহায় কন্ঠ শুনে আবরারের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। মায়ের অসুস্থতা কতটা কষ্টদায়ক তাতো ও নিজেও অনুভব করতে পারছে।
আবরার সোহেলকে বলল, “তুমি অপারেশনের ব্যবস্থা করো। টাকা যা লাগে আমি বিকাশ করে পাঠাচ্ছি। ”
সোহেল যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না!! কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আপনার জন্য অনেক দুআ করি স্যার । আজ আপনি আমার মায়ের জন্য যে দয়া দেখাইলেন , আল্লাহ যেন এর চেয়েও বহুগুণ বেশি দয়া আপনারে দেখান।’
আবরার মনে মনে বলল, “আমিন।”
সেদিন সন্ধ্যায় একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এলেন মিলিকে দেখতে। সব রিপোর্ট পরীক্ষা করে বললেন, মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরনের ভাইরাস সংক্রমণের কারণে মিলি অচেতন হয়ে আছে। উনি পাঁচদিনের ইনজেকশন কোর্স দিয়ে বললেন,“আজ রাত থেকেই এটা দেয়া শুরু করলে আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরবে মিলির।”
পরের দিন সন্ধ্যায় সোহেল ফোন করে উচ্ছসিত কন্ঠে আবরারকে বলল, “ স্যার, মায়ের অপারেশন সফল হইছে। আপনারে অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
ফোনে কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতালের নার্স ছুটে এসে বলল, “আবরার আপনার মায়ের জ্ঞান ফিরেছে, উনি আপনাকে দেখতে চাইছে।”
আলহামদুলিল্লাহ পড়তে পড়তে আইসিইউ এর দিকে ছুটে গেল আবরার।
————————————————————————————————————
মহান আল্লাহতায়ালা শারীরিক অসুস্থতার মাধ্যমে কখনও আমাদের ঈমানের পরীক্ষা নেন কখনও বা আবার গুনাহ মাফের সুযোগ করে দেন। অসুস্থ হলে একদিকে যেমন আধুনিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিকিৎসা করানো দরকার অন্যদিকে তেমনি রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা এবং নিজের সাধ্য অনুযায়ী সাদাকাহ করার কথাও হাদীসে বলা হয়েছে। মহানবী (সা:) বলেছেন-
১.‘দোয়া ছাড়া আর কোন কিছুই ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না এবং নেক আমল ছাড়া আর কিছুই হায়াত বৃদ্ধি করতে পারে না। (তিরমিজি ২১৩৯)
২.’সাদাকাহর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের রোগীদের চিকিৎসা করো। (সাহিহুল জামে-৩৩৫৮, , শাইখ আলবানি হাদিসটি “হাসান” সাব্যস্ত করেছেন)
তাই মনের আবেগ মিশিয়ে, পূর্ণ ইখলাসের সাথে দুআ কবুলের সময়গুলোতে দুআ করলে, কুরআনের শিফার আয়াতগুলো পড়ে আমল করলে এবং আল্লাহর ওয়াস্তে সাদাকাহ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় রোগমুক্ত হওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলাই একমাত্র শিফা দানকারী,বাকী সবকিছু উসিলা মাত্র।
আল্লাহ যেন শারীরিক অসুস্থতার সময়ে আমাদেরকে তাঁর আরও নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ করে দেন। আমিন।