‘সতর্কীকরণ কালচার’ : ফেলে আসা আমি ও কিছু অকপট স্বীকারোক্তি

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

পর্ব ১



(ফেসবুকে লেখালেখির একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে যদি নির্দিষ্ট অডিয়েন্সের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই, তবে শুধু তাদেরকে আলাদা করে পাওয়ার সুযোগ নেই। এই লেখাটি প্রায় এক যুগ ধরে দ্বীনী সার্কেলে ওঠাবসা করার অভিজ্ঞতা প্রসূত লেখা। তাই যারা বেশ কিছু বছর ধরে ইসলাম প্র্যাকটিস করছেন তারা লেখাটার মূল মেসেজ যেভাবে ধরতে পারবেন, একদম নতুনরা হয়তোবা পারবেন না। তবে লেখার একদম শেষে নতুনদের জন্য কিছু গাইডলাইন থাকবে ইনশাআল্লাহ। আশা করি আমাদের সাথেই থাকবেন)

এই লেখাটা যখন লিখছি তখন কোভিড-১৯ নামক আল্লাহর এক অসামান্য সৃষ্টি সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষের জীবনকে স্থগিত করে দিয়েছে। গৃহবন্দী অবস্থায় যখন চারদিকে শুধু মৃত্যু আর অসুস্থতার খবর শুনছিলাম, তখন আমার মনে হল যে এটাই হয়তোবা করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে বড় অবদান- ‘মৃত্যু’ নামক অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা আমাদের অহর্নিশ মনে করিয়ে দেয়া।

এই ‘মৃত্যু’র কথা ভাবলে আমি কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই। নিজের অজান্তেই ফিরে যাই প্রায় এক যুগ আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়ি, স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়ে খুব ফুরফুরে সময় কাটাচ্ছিলাম, চারদিকে শুধুই জীবনের জয়গান। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা মাথায় রেখে জীবন যাপন তো দূরের কথা, সেটার কথা উল্লেখ করাও ছিলো যেন অলক্ষুণে পাপ। তাই জীবনের প্রায় দুই দশক কেটে যাওয়ার পরও আমি কোনো লাশ দেখি নি! পরিচিত, আধা পরিচিত যেসব মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি, তাদের লাশ দেখি নি রাতের বেলা ভয় লাগবে বলে!

সেই আমি প্রথম লাশ দেখলাম আব্বার!!

একদম হুট করেই সবকিছু ঘটে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহবল এই আমি আমার করণীয় ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময় আমাকে মোটামুটি উদ্ধার করেছিলো আশেপাশের শুভাকাঙ্খীদের বলা হাদীসটা –

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “আদম সন্তান মারা গেলে তার সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অবশ্য তিনটি আমল বিচ্ছিন্ন হয় না; সদকাহ জারিয়াহ, উপকারী ইলম, অথবা নেক সন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে থাকে।” (মুসলিম ৪৩১০, আবূ দাঊদ ২৮৮২ প্রমুখ)

মানে আব্বার আমলনামায় এখনো ভালো কিছু যোগ করার সুযোগ আমাদের হাতে আছে। তবে হাদীসটা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছিলো যে দুআ তো করাই যায়, কিন্তু দুআটা যেন ক্ববুল হয় সেজন্য ‘নেক সন্তান’ হতে হবে যে! সেটা যে আমি না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

হতাশ না হয়ে চেষ্টা শুরু করলাম যেন আল্লাহর দরবারে ‘নেক সন্তান’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারি। ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান তখন শুন্যের কোঠায়। যে যা বলে তাই করি। পরিচিত এক আন্টি বললেন সূরা ইয়াসিন ৪০বার পড়ে ‘খতম’ দিয়ে সেটার সাওয়াব আমি আব্বাকে দিয়ে দিতে পারি। (এখন জানি এই আমলের ব্যাপারে সহীহ কোনো উৎস থেকে জানা যায় না)। যেমন কথা, তেমন কাজ, শুরু করলাম সূরা ইয়াসীন পড়া।

কিন্তু কিছুই না বুঝে একটা ভাষা পড়ে যাওয়াটা খুব অর্থহীণ লাগছিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম সময় বেশী লাগলেও, যতবার আরবী পড়বো, ততবার বাংলা অর্থও পড়বো। বাংলা অর্থ পড়তে গিয়েই আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। আল্লাহ বলছেন-

“এটা তো এক উপদেশ ও প্রকাশ্য কোরআন। যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।” (৩৬ঃ৬৯-৭০)

আমার মনে হল তাহলে কুরআন পড়াটা আব্বার জন্য যতটা না দরকার, তার চেয়ে বেশী জরুরী আমার নিজের জন্য! শুরু করলাম কুরআন পড়া, কিন্তু কিছুই যে বুঝি না…… বুঝলাম যে আমার ব্যাসিক জ্ঞানের ঘাটতি আছে। কাঁটাবনের ইসলামী বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরাঘুরি বা ইন্টারনেটে বিক্ষিপ্তভাবে নানা জিনিস পড়েও খুব বেশী আগাতে পারছিলাম না। আমার মত দিশেহারা মুসলিমদের জন্য তখন সবচেয়ে বড় কনফিউশন বোধ করি ‘সঠিক মত কোনটা’ এটা বুঝা। মুসলিমদের মাঝে এত প্রকাশ্য দলাদলি আর কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি! এইসময়ে হঠাৎ করেই ফেসবুকে আমার কিছু বোনের সাথে পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমে আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলাম শেখানো হয় এমন কিছু জায়গার খোঁজ পাই।

আলহামদুলিল্লাহ, তখন থেকে আমার ‘স্ট্রাকচারডভাবে দ্বীন শিক্ষা’র যাত্রার শুরু। এই দীর্ঘ যাত্রায় স্কলারদের অধীনে আমি যা কিছু শিখেছি তা এক কথায় অমূল্য। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে এই সময়টাতেই আমি পরিচিত হয়েছি তথাকথিত ‘সতর্কীকরণ কালচার’ এর সাথে। আমাদের সবসময় বলা হত কার লেকচার শোনা যাবে, কারটা যাবে না, কার বই পড়া যাবে, কারটা যাবে না ইত্যাদি। সেই লিস্ট আবার নিয়মিত আপডেট হত। আজকে যে গ্রীন সিগন্যাল পেয়েছে, কালকে যে সে ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যাবে না এমন না। সিনিয়রদের সেইসব উপদেশ আমি সবিনয়ে মেনে নিতাম, কিন্তু একটা প্রশ্ন আমি সবাইকে করতাম- ‘এই যে আমরা মুসলিমরা এত দ্বিধা বিভক্ত, এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?’

আমি একটা কমন উত্তর পেতাম- ‘আক্বীদা শুদ্ধ করা’। মানে আমাদের আক্বীদা ঠিক হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, আমরা এক উম্মাহ হয়ে যাবো। আমরা বাদে আর সব দলের সমস্যা হচ্ছে তাদের আক্বীদা বিশুদ্ধ না। অন্য সব দলের আক্বীদার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের পড়ানো হত, কেন তারা পথভ্রষ্ট সেটা আমাদের জানানো হত। ফলে আমি একটা দারুণ স্কিল অর্জন করলাম-

১) আমি মানুষকে ক্যাটাগরাইজ করতে শিখলাম- অমুক তো তাব্লিগি, তমুক জামাতী, অমুক হিজবুত তাহীরী, তমুক সুফী, অমুক দেওবন্দী, না হয় তমুক আহলে হাদীস ইত্যাদি অসংখ্য শ্রেণীবিভাগ। এই প্রত্যেকটা ক্যাটেগরীর কিছু কমন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হত, যেগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আমি যাচ্ছি না।

২) কোনো মুসলিম দা’ঈ বা পাব্লিক ফিগারের কাজের সাথে নতুন পরিচিত হলে প্রথমেই বোঝার চেষ্টা করতাম তার আক্বীদা সহীহ আছে নাকি। আমার মধ্যে মানুষকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখে ফিল্টার করার একটা প্রবণতা তৈরি হল। ফিল্টারে আটকে গেলেই ব্ল্যাক লিস্টেড!

৩) বিভিন্ন স্কলারদের বা দলের ভুলগুলোর ব্যাপারে অন্যকে সতর্ক করাটাকে আমি ইসলামের এক ধরণের খিদমত করা ভাবা শুরু করলাম……ইত্যাদি।

পর্ব ২

ভালোই চলছিলো সব কিছু। নিজের মাঝে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করতাম যে আমি জামাতী, তাব্লিগি বা অমুক বা তমুক না, ‘আহলে সুন্নাহ ওয়া জামাআ’ এর অনুসারী। ঠিক এমন সময়ে আমার জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে…………

১) আমি দেশের বাইরে চলে আসি। এটাকে আমি বলি যে ‘Homogeneous Group (আমার সব কথার সাথে হ্যাঁ বলে এমন মানুষদের সার্কেল’) বা ‘Comfort Zone’ ( আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি এমন পরিবেশ) থেকে বেরিয়ে আসা।

২) আমাদের যেসব স্কলারের লিস্টের ব্যাপারে ‘গ্রীন সিগন্যাল’ দেয়া হত, এমন কয়েকজনের সাথে আমি একদম হাতে কলমে কাজ করার সুযোগ পাই।

এগুলো আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো। কেন, সেটা বলছি।

দেশের বাইরে এসে আমি একদম ভিন্ন ধর্মী দুই ধরণের মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পেলাম। একটা হল ইসলামের ধারে কাছেও নেই এমন মানুষ। তাদের সাথে মিশতে গিয়ে আমি বুঝলাম যে ‘শুদ্ধ আক্বীদা’ বা এইসব ভারী ভারী টার্মগুলো একদম সাধারণ মানুষের কাছে দাওয়াতী কাজ করার জন্য একেবারেই অনুপুযুক্ত। এটা কমন সেন্স হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে দ্বীন প্র্যাক্টিস শুরু করার আগের আমার মনস্তত্ত্ব আমি যেন ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার আশেপাশের মানুষগুলো যে ইসলাম থেকে ঠিক কতটা দূরে চলে গিয়েছে সেটাও যেন আমার খেয়ালে ছিলো না। আমি যেন নতুন করে উপলব্ধি করলাম যে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হলে প্রথমেই দরকার কাউকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা। আমার কাছে এসে সবাই যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু ঐ যে সতর্কীকরণ কালচারের বদৌলতে অর্জিত ফিল্টার করার প্রবণতার কথা বললাম, সেটা কেমন যেন আমার স্বভাবের অংশ হয়ে গিয়েছিল। দেখা গেল যে কোনো মানুষকে ‘বাই ডিফল্ট’ অবিশ্বাস করছি, তাকে ক্যাটাগরাইজ করা শুরু করছি, একটা দুইটা ঘটনা থেকেই তার ব্যাপারে কোনো উপসংহারে চলে আসছি। আমি না চাইলেও যেন অন্যের ভুলগুলোই আগে দেখতে পেতাম, নিজের ভুলগুলো কম চোখে পড়তো……… নিজের এই পরিবর্তনে আমি এক ধরণের অস্থিরতা বোধ করা শুরু করলাম।

এই একই সময়ে আমি আমার ঘরানা ছাড়াও অন্য দলের প্র্যাক্টিসিং মানুষদেরও সংস্পর্শে আসলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে কখনো সামনা সামনি না মেশায় তাদের ব্যাপারে যা ভাবতাম তার অনেক কিছুই ছিলো ভুল। তাদের চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম সব কিছুর সাথে আমার উদ্দেশ্য ও কাজের যতটা না অমিল, মিল তার চেয়ে বেশী। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি অন্য ঘরানার হওয়াতে তাদেরও আমার ব্যাপারে একই ধরণের অস্বস্তি বা অনাস্থা ছিলো, ঠিক যেমনটা আমার ছিলো তাদের ব্যাপারে। আমি বুঝলাম যে এই সতর্কীকরণের কালচারটা যে শুধু আমি যেখান থেকে ইসলাম শিখেছি সেখানকার বৈশিষ্ট্য, ব্যাপারটা এমন না, এটা সকল ইসলামপন্থীদের মাঝে একটা কমন ব্যাপার। ব্ল্যাক লিস্ট করতে অভ্যস্ত আমি যেন তখন বুঝতে পারলাম যে ব্ল্যাক লিস্টেড হতে কেমন লাগে! আমার অস্থিরতা বেড়ে গেল।

আমি যখন ‘আমার ঘরানার’ বড় বড় স্কলারদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করলাম তখন তাদের মানবীয় দিকটা দেখার সুযোগ হল। দেখলাম তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, তাদের আবেগ, তাদের ভুলগুলো। তাদেরও এমন কিছু ভুল ছিলো যা হয়তো অন্য ঘরানার স্কলার হলে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ হওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। আমি বুঝলাম যে কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে না, থাকতে পারে না, আমরা কারোটা জানি, কারোটা জানি না।

সত্যি কথা হচ্ছে এভাবে একসময় ‘সতর্কীকরণ কালচারের’ প্রতি আমার এক ধরণের বিতৃষ্ণা জন্ম নিল। সেটা একদম চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলো যখন আমি দেখলাম যে আক্বীদা ঠিক থাকলে সব ঠিক এই শ্লোগান দেয়া মানুষগুলো তাদের নিজেদের আক্বীদার মানুষের সাথে ঐক্য বজায় রাখতে পারছে না। তারা আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ছে, একজন আরেকজনকে বিষেদগার করছে। তখন আমার দৃঢ়ভাবে মনে হওয়া শুরু হল যে যদিওবা আক্বীদা নিয়ে বিশুদ্ধ উৎস থেকে পড়াশোনা করার কোনো বিকল্প নাই, তারপরও ‘শুদ্ধ আক্বীদার’ অনুসারী হলেই আমাদের মাঝে ঐক্য চলে আসবে ব্যাপারটা এমন নয়। সাথে আমাদের দরকার আরো কিছু।

কী সেটা?



পর্ব ৩

আমি হন্যে হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, অনেক দুআ করতে লাগলাম। সেই দুআর বদৌলতেই হয়তোবা আমি চারপাশকে খোলা দৃষ্টি নিয়ে দেখতে শিখলাম। ফলে আমি সতর্ক করা টাইপের লেখা/ ভিডিও গুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম (অবশ্যই ব্যতিক্রম থাকতে পারে, নিঃসন্দেহে আমি নিজেই এখানে কিছু জেনারালাইজেশন করছি) যেগুলো আগে টের পাই নাই। এখানে উল্লেখ্য যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমি বুঝতে পেরেছি যখন থেকে আমি নিজেই অন্যদের দ্বারা অনাস্থা বা অবিশ্বাসের স্বীকার হয়েছি বা যাদের ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে তাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে মিশেছি/ তাদের লেকচার নিজে অনেক শুনেছি, তারপর। তার আগ পর্যন্ত আমার কাছে এই কাজগুলো ইসলামের খেদমত বলেই মনে হত। যাই হোক, আমার দেখা মতে বৈশিষ্ট্যগুলো হল –

১) এধরণের লেখা/ভিডিওগুলোতে কোনো স্কলার/ দা’ঈর ব্যাপারে সতর্ক করা হয় তাদের কোনো বক্তব্যের ২-৩ মিনিট বা লেখার খণ্ডিত অংশের ভিত্তিতে। ফলে বক্তা কোন প্রেক্ষিতে, কোন অডিয়েন্সের সামনে কেন কোনো কথা বলেছেন বা লিখেছেন সেটা বোঝার অবকাশ থাকে না।

২) লেখা/ লেকচারগুলোতে মূল বক্তার বক্তব্য সবসময় নিজের মত করে ব্যাখ্যা করা হয়। ‘অমুক এটা বলেছেন, তার মানে উনি বুঝাতে চাইলেন যে…………’ এই টাইপের বাক্যাংশ আমি সবসময় দেখি/ শুনি।

৩) ভিডিওগুলো শুনলে বোঝা যায় যে বক্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘শোনা কথার ভিত্তিতে’ সতর্ক করছেন। মানে যার ব্যাপারে সতর্ক করছেন তার লেকচার, কাজ কর্মের ব্যাপারে উনার তেমন বিস্তারিত আইডিয়া নেই। কেউ কোনো বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ পাঠিয়েছে, সেটা থেকেই উনি একটা উপসংহারে পৌঁছে গেছেন এবং সতর্কতামূলক লেখা/ লেকচার তৈরি করে ফেলেছেন।

৪) এক বা একাধিক ব্যক্তির ভুল থেকে একটা বড় গ্রুপ বা দলের ব্যাপারে উপসংহারে পৌঁছানো হয়ে যায়। অমুক এমন করেছেন, যারা পশ্চিমা দেশে থাকেন তারা তো এমন বলবেনই, বা ও আচ্ছা তমুক, উনার তো জামাত/ তাব্লিগি ব্যাকগ্রাউণ্ড, তাহলে এছাড়া আর কী আশা করা যায় তাদের থেকে… ইত্যাদি।

৫) এই সতর্কতার খড়্গহস্ত থেকে কেউ রেহাই পায় না। এ যেন লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়ের মত অবস্থা। দিন শেষে বক্তব্যটা এমন দাঁড়ায় যে সবাই পথভ্রষ্ট, শুধু আমি আর আমি যাদের কথা বললাম তারাই ঠিক।

৬) স্কলার/ দা’ঈদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গী থাকে বাইনারী।মানে হয় শুন্য না হয় এক। এর মাঝামাঝি কিছু নাই। মানে হয় কারো সব কথা শোনা যাবে, নাহলে কিছুই যাবে না। মানুষকে এইভাবে গড়ে তোলার কোনো প্রবণতা নাই যেন তারা নিজেরাই ভুল ও ঠিকের মাঝে পার্থক্য করতে শেখে। এই ব্যাপারটা খুব কষ্ট লাগে আমার কাছে।

৭) ভিডিওগুলো খুবই আপত্তিকর ভাবে এডিটিং করা হয়। বক্তা হয়তো বা যার ব্যাপারে সতর্ক করছেন তার নাম উল্লেখ করছেন না, এডিটর তার ছবি ইনসেটে যোগ করে দিবেন। বক্তা হয়তোবা কোনো ভুলের দিকে ইঙ্গিত করছেন, ইনসেটে সেই ভুলটা গোল দাগ দিয়ে দেখানো হয়। যারা সূরা হুজুরাত ১১-১২ আয়াত একবার পড়া আছে সে মাত্রই বুঝতে পারবে এই কাজগুলি অনুচিত। টাখনুর উপরে পোশাক না পড়ার আর দাঁড়ি ছেড়ে না দেয়াকে চোখে আঙ্গুল তুলে দেখাতে গিয়ে আমরা যে আচরণগত সুন্নাত ভুলতে বসেছি তা আমাদের কে বুঝাবে?

এসব ব্যাপার চোখে পড়ার পর এই পুরো সতর্কীকরণ কালচারের ব্যাপারটা আমার কাছে খুব নিষ্ঠুর মনে হওয়া শুরু হল। কারণ সতর্ক করা হচ্ছে এমন লেকচার শুনলে বা লেখা পড়লে আমার মনে হত ভুল ধরার জন্য যেন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে বসেছিলো, পাওয়ার সাথে সাথে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ঝাঁপায় পড়েছে। মানে ভুলগুলো পাওয়াতে উনারা খুব খুশী। আমি জানিনা কেন আমার এমন মনে হত, কিন্তু এমন মনে হওয়াটা আমি আজো এড়াতে পারি না! প্রচণ্ড ঘৃণার যে চাষ আমি দেখতাম সেটা আমাকে ভীত করে তুলতো।

ইসলাম নিয়ে যে সামান্য পড়াশোনা আমার ছিলো, তাতে আমার মনে হল যে আল্লাহতো আমাদের কাছ থেকে পারফেকশন চান না, তাহলে আমরা কেন মানুষের সাথে এমন করি? নিচের হাদীসটা আমাকে খুব আবেগাপ্লুত করে-

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “আমাদের রব প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তিনি বলেনঃ কে আমাকে আহ্বান করবে আমি তার ডাকে সাড়া দিব, কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে আমি তাকে প্রদান করব, কে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব”। [বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, ইব্‌ন মাজাহ ও নাসায়ি]

এটা পড়লে আমার মনে হয় যে আল্লাহ জানেন তার বান্দা প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভুল করবে এবং তার ক্ষমার দরকার হবে, তাই উনি এই দরজা খোলা রেখেছেন প্রতিদিন, সপ্তাহে বা মাসে বা বছরে একবার না। আমাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, ইসলামের এই দিকটা আমাকে খুব টানে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে একজন মানুষ ছিলেন, কুরআনে আল্লাহ একাধিকবার সেটার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।তার মাঝে নিচের আয়াতগুলো আমার খুব প্রিয়-
বলুনঃ পবিত্র মহান আমার পালনকর্তা, একজন মানব, একজন রসূল বৈ আমি কে? আল্লাহ কি মানুষকে পয়গম্বর করে পাঠিয়েছেন? তাদের এই উক্তিই মানুষকে ঈমান আনয়ন থেকে বিরত রাখে, যখন তাদের নিকট আসে হেদায়েত। বলুনঃ যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করত, তবে আমি আকাশ থেকে কোন ফেরেশতাকেই তাদের নিকট পয়গাম্বর করে প্রেরণ করতাম। (১৭: ৯৩-৯৫)


অর্থ্যাৎ আমরা মানুষ বলেই আমাদের জন্য রাসূল হিসেবে একজন মানুষ পাঠানো হয়েছে, ফেরেশতা নয়।

এসব পড়ে আমার মনে হতে লাগলো, এই যে আমরা অন্যকে এক ফোঁটাও ছাড় দিচ্ছি না, সেভাবে আল্লাহ যদি আমার আমলনামাটা দেখেন, তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা?

পর্ব ৪



আমি তখনো আমাদের এহেন অসহিষ্ণু আচরণের কারণ খুঁজে ফিরছি। এটা সেই সময় যখন আমি ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটা লিখছি, যেটার মূল ফোকাস ছিলো বনী ইসরাঈলের স্বভাবদের সাথে আমাদের সাদৃশ্য। সেটা করতে গিয়েই সূরা বাক্বারার নিচের আয়াতটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুললো:

যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন তা মেনে নাও, তখন তারা বলে, আমরা মানি যা আমাদের প্রতি অবর্তীণ হয়েছে। সেটি ছাড়া সবগুলোকে তারা অস্বীকার করে। অথচ এ গ্রন্থটি সত্য এবং সত্যায়ন করে ঐ গ্রন্থের যা তাদের কাছে রয়েছে। বলে দিন, তবে তোমরা ইতিপূর্বে পয়গম্বরদের হত্যা করতে কেন যদি তোমরা বিশ্বাসী ছিলে? (২ঃ৯১)

এখানে বনী ইসরাঈলের কথা বলা হচ্ছে। ওরা নিশ্চিতভাবে জানতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন, তবু ওরা ঈমান আনছিলো না কারণ ঊনি ওদের গোত্রের ছিলেন না। এই প্রেক্ষিতে একটু খেয়াল করে দেখি যে উপরের আয়াতে আল্লাহ ওদের কী বলছেন।

আল্লাহ ওদের ঈমান আনতে বলছেন আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন সেটার উপর, মানে উৎসটার প্রতি ফোকাস করতে বলছেন, কে প্রচার করছে সেটা না। কিন্তু বিপরীতে ওরা কী বলছে? ওরা বলছে শুধু ওদের কাছে যা নাযিল হয়েছে, সেটাই মানবে। মানে আল্লাহর কন্সেপ্টটা ওরা সরিয়ে দিচ্ছে, ওদের কাছে যা আছে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হতে হবে জরুরী না, ‘ওদের কাছে আছে’ এই ব্যাপারটাই বেশী জরুরী।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ওদের কাছে কী আছে, এটাই ওরা জানে না। যদি জানতো তাহলে বুঝতো যে দুই পক্ষ একই কথা বলছে মানে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের কাছে থাকা কিতাবেরই সত্যায়ন করছেন। তারপর আল্লাহ ওদেরকে আরো বলছেন যে তোমরা যদি নিজেদের গোত্রের কাছে প্রেরিত হলেই শুনবা, তাহলে আগের নবীদেরকে হত্যা করতে কেন? তারমানে নিজেদের গোত্র না বলে যে শুনছোনা, এই দাবীটা মোটেও সত্যি না।

এই আয়াতটা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হঠাৎ করেই আমার মনে হল যে এই আয়াতটা যেন আমাদের সময়ের সাথে একদম হুবহু মিলে যায়। কিভাবে? (এটা সম্পূর্ণ আমার মস্তিষ্কপ্রসূত, তাই অবশ্যই আমার বোঝায় ভুল থাকতে পারে)।

‘সতর্কীকরণ কালচারের’ নামে আমরা স্কলারদের ব্ল্যাক লিস্ট বানানোর যে কাজটা করি সেটার পেছনে এক ধরণের ‘আমিত্ব’ কাজ করে। আমি যা বুঝি, আমি যা শিখেছি সেটাই একমাত্র ঠিক, আর সবাই ভুল। আমার দল, আমার স্কলার, আমার মাযহাব-দিন শেষে আমার কাছে অগ্রাধিকার পেতে থাকে শুধুই ‘আমি’।

সতর্কীকরণ ভিডিওগুলো একটু খোলা মন দিয়ে দেখলেই এই আমিত্ব জাহির করার ব্যাপারটা চোখে পড়বে। এই লেখাটা লেখার জন্য আমি এমন একটা ভিডিও দেখছিলাম, সেখানে দেখলাম যে বক্তা প্রথম ৪-৫ মিনিট ধরে শুধু এটাই বললেন যে যার ব্যাপারে সতর্ক করছেন তাকে উনি কখনো দেখেন নি, মেশেন নি, তার প্রতি উনার কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই, উনি নিজে ভুল সম্বলিত ভিডিওটা খুঁজে বের করেন নাই, এক ভাই তাকে পাঠিয়েছেন, এই সময়টা উনি কুরআন পড়তে পারতেন, এসব ভিডিও বানিয়ে অনেক লাইক, কমেন্ট পাওয়া উনার উদ্দেশ্য না, উনি খ্যাতির মোহে এসব করছেন না,…..উনি করছেন আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ‘গীরাহ’ বোধ থেকে……ইত্যাদি। সত্যি কথা হচ্ছে এভাবে আত্মপ্রশংসা শুনতে আমার এত অস্বস্তি লাগছিলো! কথাগুলো যদি শতভাগ সত্যিও হয়, আমার মনে হচ্ছিল যে এসব বলে উনি নিজেই উনার বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন। কারণ

• ভিডিওটাতে বলা হচ্ছে যে উনি বক্তার সাথে কখনো মেশেন নি, দেখেন নি মানেই হচ্ছে উনি তাকে তার ভুল সংশোধন করিয়ে দেয়ার কোনো চেষ্টা চালান নি। আমার মুসলিম ভাই এর কি এই অধিকার নেই? নিচের হাদীস থেকে এমনটাই তো মনে হয়!

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: এক মু’মিন অন্য মু’মিন ভাই-এর জন্য আয়না তুল্য (দোষের কথা তাকে ধরিয়ে দেবে কিন্তু অন্যের কাছে তা গোপন রাখবে)। সহীহ হাদীস, আবূ দাঊদ ৪৯১৮, তিরমিযী ১৯২৯

আমার জানায় ভুল থাকতে পারে, কিন্তু আমার জানামতে আন্তরিক নাসীহার বৈশিষ্ট্যই তো হচ্ছে সেটা হবে গোপন। প্রথমে তাকে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টা জানানো উচিত, তার বক্তব্য শোনা উচিত, সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত। আমি বলছি না যে মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে পাবলিকলি বলা যাবে না, কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে পাবলিকলি বলার আগে অবশ্যই বক্তার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত।

• আরো বলছেন এক ভাইয়ের পাঠানো কয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপ এর ভিত্তিতে এই সতর্কীকরণ ভিডিও আপলোড করেছেন। আচ্ছা আমাকে কেউ কিছু পাঠালেই আমি সেটা যাচাই বাছাই না করে এভাবে সতর্ক করা শুরু করবো? এমন তো হতে পারে যে আমি যা ভাবছি উনি সেটা বুঝান নাই। আমার বুঝার ভুল হতে পারে এই সামান্য বিনয়টুকু কি আমাদের ব্যাসিক বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত না?

আমার কাছে এই আত্মপ্রেমী আচরণটা ঠিক বনী ইসরাঈলের মত লাগে- আমার কাছে যা নাযিল হয়েছে তার বাইরে আর সব কিছুই বাতিল। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে নিজের এই আমিত্ব বোধের কারণেই হয়তোবা সেই লিস্টটা ছোট হতে থাকে, কারণ নিজের দল হলেই যে আমি মেনে নিবো তা না, একদম আমার মনের মত হতে হবে। ঠিক যেমন নিজের গোত্র হওয়া সত্ত্বেও বনী ইসরাঈল ওদের নবীদের হত্যা করেছিলো। এটা বলছি এইজন্য যে আমি দেখেছি যদিও আমাদের প্রথমে বলা হত আক্বীদাই আসল, কিন্তু পরে খেয়াল করে দেখেছি যে আস্তে আস্তে লিস্টে বহুমাত্রিক আরো বৈশিষ্ট্য যোগ হচ্ছে। পশ্চিমা দেশে থাকলে বা দাঁড়ি ছাটলে এমনকি সি সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিলেও (নরমাল ডেলিভারীকে কিভাবে যেন আমরা তাক্বওয়ার সাথে জড়িত করে ফেলেছি!) ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যেতে দেখেছি। এভাবে আমরা একটা Cult মানসিকতা গড়ে তুলেছি। মানে হয় তুমি আমার বন্ধু নাহলে শত্রু, মাঝামাঝি কিছু নাই। কিংবা হয় তোমার সাথে আমার গলায় গলায় খাতির, নাইলে মেশাই যাবে না, এরকম। যদি আমি পছন্দ করি না এমন কারো সাথে তোমার খাতির থাকে, তাইলেও তুমি বাদ!

এই আমিত্বের প্রকাশ আমি আরো দেখেছি নিজেদের ঘরানার স্কলারকে ডিফেণ্ড করার সময়। ধরুন ‘আমি’ পছন্দ করি এমন স্কলারের সমালোচনা করে কোনো লেখা আমার সামনে আসলো, আমি তাকে অনেক ‘Benefit of doubt’ দেই। উনি আসলে এটা বুঝান নাই, উনি আসলে অমুক প্রেক্ষিতে বলেছেন, এভাবে কাট পেস্ট করে কোনো ভিডিওর অংশ বিশেষ থেকে উপসংহারে পৌঁছানো উচিত না ইত্যাদি অসংখ্য যুক্তি দেয়া হয়, কিন্তু আমার পছন্দ নয় এমন স্কলার হলে আর বলি না যে এভাবে কয়েক সেকেণ্ডের ভিডিও দিয়ে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত না, কোন প্রেক্ষিতে বলেছেন এটা বুঝতে হবে ইত্যাদি। তাই আমি বলি যে নিজের পছন্দের স্কলারদের নিয়ে ‘সেলিব্রেটি কালচার’ আর অন্যদের নিয়ে ‘সতর্কীকরণ কালচার’ মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। দুটোই সমান পরিত্যাজ্য আমার কাছে কারণ স্কলাররা মানুষ, তারা ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। নিজের পছন্দের স্কলার হলে এমন ভাবা যাবে না যে, অমুক যখন বলেছেন, তখন নিশ্চয়ই জেনে বুঝেই বলেছেন। স্কলারদের সম্মান করা আর পূজা করার মাঝের পার্থক্যটা আমাদের বুঝতে হবে।

পর্ব ৫



আমরা যদি শুধু নিজেদের না, সব ঘরানার স্কলারদের প্রতি সহনশীল হতাম আর তাদের কথা একটু শুনতাম আর খোলা মন নিয়ে বিশ্লেষণ করতাম তাহলে দেখতাম যে মোটামুটি ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারতাম, যেমনটা আল্লাহ বলছেন যে ওরা জানেনা যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের কিতাবেরই সত্যায়ন করছে।

একটা উদাহরণ দেই- সম্প্রতি একজন জনপ্রিয় পশ্চিমা স্কলারের একটা বক্তব্যের অংশবিশেষ নিয়ে খুব বিতর্ক উঠলো যে উনি মন্তব্য করেছেন যে ইসলামের হুদুদ আইন এগুলো আমাদের সময়ে ‘Bizarre এবং Problematic’। জাত গেলো জাত গেলো রব উঠলো, উনার ব্যাপারে সতর্ক করে নাসীহামূলক পালটা ভিডিও আপলোড করা হল……তো আমি সেই স্কলারের একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম যেখানে তাকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হল। উনার উত্তরটার সারমর্ম আমি এখানে তুলে ধরছি-

‘প্রথমেই বলে নেই যে আমি যদি এভাবে আমার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের জবাব দিতে চাই, তাহলে কোনো গঠনমূলক কাজ করার সময়ই পাবো না। তবে যে ১০-১৫ সেকেণ্ড ভিডিও ক্লিপ প্রচার করা হচ্ছে সেটা আমি এমন এক শ্রোতার সামনে দিয়েছি যারা ইসলামকে স্রেফ জঙ্গীবাদের ধর্ম মনে করে এবং জীবনে এই প্রথম কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের ধারণা মুসলিমরা ক্ষমতায় আসলে এসব বর্বর আইন প্রয়োগ করে তাদের জীবন বিপন্ন করে ফেলবে। তাদেরকে আমি বলেছি যে আজকের প্রেক্ষিতে এসব আইন ‘Bizarre এবং Problematic’ মনে হতে পারে, কিন্তু সেগুলো তাদের জীবনকে কোনো ভাবে প্রভাবিত করবে না। আমার এই কথাটা সমস্যাযুক্ত মনে হবে তাদের কাছে যারা হাদীস বা ফিকহের উচ্চতর লেভেলে পড়েনি। যেমন আল তাহায়ীর একটা বিখ্যাত বই আছে- “A commentary on problematic hadiths” (Sharḥ Muskhil al-Athār); ইবনে ফাওরাক এরও আছে- “Problematic Hadiths” (Mushkil al-Ḥadith). তারা স্কলারদের এমন লেখা পাবেন যেখানে তারা একটা হাদীস বা কুরআনের আয়াত উল্লেখ করে বলছেন যে এটা ‘Problematic’। হতে পারে ব্যাকরণগত দিক থেকে বা অন্য কোনো ব্যাপারে, তারপর তারা সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন কিভাবে এই আপাত সমস্যাটা সমাধান করা যায়। ঠিক সেরকম আমি বলেছি যে আমাদের আধুনিক নৈতিকতা দিয়ে বিচার করলে ইসলামী আইনগুলোকে সমস্যাযুক্ত মনে হবে, আমাদের এগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। আমি কখনোই বুঝাই নাই যে ইসলামী আইনগুলো সমস্যাযুক্ত। আসলে যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারাই সব কিছুতে ভুল ধরে আর যারা একনিষ্ঠ, তারা অন্যকে অবকাশ দেয়, বোঝার চেষ্টা করে যে আমি আদতে কী বলেছি। তাছাড়া আমার হাজারখানেক অন্য লেকচার আছে যেখান থেকে হুদুদ আইনের ব্যাপারে আমার অবস্থান স্পষ্ট বোঝা যায়।’

আমি ওনার বক্তব্য এত বিস্তারিত তুলে ধরলাম এটা বোঝাতে যে কাউকে খারিজ করে দেয়ার আগে তার বক্তব্য সামগ্রিকভাবে বিচার করা উচিত, উনি কি বুঝিয়েছেন এটা নিজেরা অপব্যাখ্যা না করে ওনাকেই সুযোগ দেয়া উচিত ব্যাখ্যা করার। আর তাহলে আমরা বুঝবো যে অমিলের চেয়ে মিলের জায়গাটাই বেশী।

‘সতর্কীকরণ কালচারের’ ‘আমি কেন্দ্রিক’ দিকটা বোঝার পর এটার নেতিবাচক দিকগুলো আরো প্রকট হয়ে আমার সামনে ফুটে উঠলো। সেগুলো উল্লেখ করার আগে আমার জীবন থেকে নেয়া কিছু উপলব্ধি শেয়ার করতে চাই।

আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের একটা টিপিক্যাল রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। ধর্মীয় আবহ আমার পরিবারে যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত ছিলো, তবে মূলত কালচার হিসেবে। আমি স্বভাবগত ভাবেই একটু বিদ্রোহী/ যুক্তিবাদী টাইপ ছিলাম, আমাকে কোনো কিছু করতে নিষেধ করা হলে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হত ‘কেন’। আমি যদি কারণটার ব্যাপারে কনভিন্সড হতাম, শুধু তাহলেই আমাকে বিরত রাখা যেত। একটা উদাহরণ দেইঃ আমার আব্বার খুব অপছন্দ ছিলো যে আমি ভারতীয় লেখকদের/ তসলিমা নাসরিনের বই পড়ি। কেন জিজ্ঞেস করলে আব্বা কোনো সদুত্তর দিতে পারতেন না। ফলাফল? আমি লুকিয়ে চুরিয়ে তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে হেন কোনো ভারতীয় লেখক নাই যাদের বই পড়ি নাই।

তারপর বহু বছর পর আমি যখন ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম, যে বইটা দিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেটা ছিলো এই এখুনি দাজ্জাল এসে পড়লোরে টাইপ একটা বই (সঙ্গত কারণেই আমি বইটার নাম উল্লেখ করছি না)। ‘সূরা কাহফের লেন্স দিয়ে জীবন দেখা’ সিরিজে আমি আমার সেই অভিজ্ঞতা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি, এখানে আর পুনরাবৃত্তি করছি না। মূল কথা হল শুরুর দিকে আমি যা পড়ছিলাম, জানছিলাম সেগুলোতে যে মারাত্মক ভুল ছিলো সেটা বুঝতে এবং শোধরাতে আমার বহু বছর লেগে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভুলের দুর্বিপাকে হারিয়ে যাইনি।

আমি যখন বাহ্যত ইসলাম প্র্যাক্টিস করা শুরু করলাম, তখন আমার মধ্যে নন প্র্যাক্টিসিং বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের কাজ কর্ম অনবরত শুধরে দেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হল। আমি হয়ে গেলাম ‘হারাম পুলিশ’। আমার ধারণা ছিলো এর মাধ্যমে আমি ‘সৎ কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ’ এর দায়িত্ব পালন করছি। যদি আমি ভুল ধরিয়ে দেয়ার পরও কেউ বিরত না থাকতো, আমি তাদেরকে ‘Lost case’ ভেবে তাদের সাথে মেশা বন্ধ করে দিতাম। আমার মনে হত যে আমি যদি তাদের সাথে চলাফেরা করি, তাহলে তাদের অনৈসলামিক কাজগুলোকে প্রকারান্তরে বৈধতা দেয়া হবে। এটা যে একটা ভুল স্ট্রাটেজি ছিলো সেটা আমি অনেক পরে বুঝেছি। কারণ আগেও বলেছি যে দ্বীন মানা শুরু করার আগের আমার মনস্তত্ব শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে কলেজে থাকতে একবার আমার এক খুব ধার্মিক আত্মীয়া আম্মাকে বললেন মেয়েকে এভাবে লাল সালোয়ার কামিজ পরে বাইরে নিয়ে এসেছো! (আমি তখন পর্দা করি না, ইসলামের ধারে কাছেও নাই) শুনে আমার এত মেজাজ খারাপ হয়েছিল! আমি ওনার বাসা থেকে বের হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই আম্মাকে বলছিলাম যে নিজের ছেলের যে ডিভোর্স হয়েছে তার হুশ নাই, অন্যের ছেলেমেয়েদের উপর মাতব্বরির অভ্যাস যায় না! আমার একবারো মনে হয় নি যে ঠিকই তো বলেছে, আমাদেরতো পর্দা করেই চলা উচিত!

এসব কথা এই ‘সতর্কীকরণ কালচারের’ প্রেক্ষিতে কেন বলছি? আমার কাছে মনে হয় যে আমরা যদি কারো মাঝে কোনো পরিবর্তন আনতে চাই, আমাদের মানুষের ব্যাসিক সাইকোলজি জানা খুব দরকার। মানুষের স্বভাবটাই সম্ভবত এমন যে তাকে কিছু করতে মানা করলে সে সহজে শুনতে চায় না। তাকে সময় দিতে হয়, ঠিকমত কনভিন্স করতে হয়। তা না করে সারাক্ষণ কানের কাছে তুমি ভুল, তুমি ভুল বললে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এসব ব্যাপার আমি নিজের জীবনে আমি অনেক ঠেকে শিখেছি। এই যে আমি গোপনে হলেও আব্বার অপছন্দের বইগুলো পড়তাম, প্রথম দিকে আমার পরিবার, আত্মীয় স্বজনদের থেকে নিজেকে আলাদা করে কারোর মাঝে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি নাই……এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন চিন্তা করেছি তখন বুঝেছি আমার ভুলগুলো। যখন আমি তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশেছি, তাদের অনুভূতিগুলো তাদের মত করে বুঝতে চেষ্টা করেছি, তাদের জন্য আকুল হয়ে আল্লাহর দরবারে কেঁদেছি, তখন আলহামদুলিল্লাহ ধীরে ধীরে একই পথের যাত্রী হতে পেরেছি।

মানুষের ব্যাসিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো না বুঝে আমরা যদি অমুক দল, তমুক স্কলার, এদের ব্যাপারে সতর্ক করতে থাকি তাহলে ফলাফল কী হয়?

১) এটা একটা আত্মবিধ্বংসী কালচারের দরজা খুলে দেয়। যারা অন্যদের সমালোচনাতে সরম থাকেন, তাদের মুখোশ উন্মোচনের কাজটা আবার করেন অন্যরা। ‘অন্যের জন্য কাটা গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়’ টাইপ অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে আসল কাজটা কিছুই হয়না, মানে যদি আসলে কেউ ভুলের মাঝে থাকে, সেটা আর সংশোধিত হয় না। মাঝখান থেকে বৈরীতা আর ঘৃণার বেসাতি গড়ে মুসলিমদের মাঝে একটা অলংঘনীয় প্রাচীর তৈরি হয়। আমরা নিজের ঘরানা ছাড়া অন্য কারো কথা একদম কানেই তুলিনা। এই সমস্যাটা সম্ভবত তীব্রভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে এই করোনাকালে। মসজিদে জামাতে সালাত আদায় হবে কী হবে না সেটা নিয়ে স্কলারদের থেকে আমরা কোনো অভিন্ন নির্দেশনা পাইনি, ভুগেছি সিদ্ধান্তহীণতায়।

২) আমাদের এই বর্জনের ডাক দেয়ার অভ্যাস শুধু স্কলার না, সবার মাঝেই সংক্রমিত হয়, যেমনটা আমার হয়েছিলো- সবাইকেই খালি ফিল্টার করতাম আর লিস্ট আপডেট করতাম। এভাবে নিজের অজান্তেই আমরা তথাকথিত প্র্যাক্টিসিংরা চরম সংকীর্ণমনা আর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাই বলেই আমরা আমজনতার হৃদস্পন্দন বুঝি না, ফলে আমাদের কথা বার্তা, কাজকর্ম সব কিছু তাদের কাছে আজব লাগে, তারা ইসলামী জীবন আদর্শের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করে না।

৩) আমরা দাওয়াতী কাজের সুবর্ণ সুযোগ হারাই। যেমন আল্লাহর এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ সৃষ্টি- ‘করোনা’ যেভাবে সমগ্র বিশ্বের মানুষকে গৃহবন্দী করে ফেললো সেটাকে নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করে আমরা বহু মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে পারতাম, কিন্তু কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে ব্যস্ত থাকায় সেটা করার সময় আমাদের হয় নি।

৪) আমরা একটা অথর্ব প্রজন্ম তৈরি করছি যাদের কার কাছ থেকে দ্বীন শিক্ষা করবো আর কার কাছ থেকে করবো না, সেটা বের করতেই অধিকাংশ সময় কেটে যাচ্ছে, দ্বীনের জ্ঞান আর অর্জন করা হচ্ছে না। ফলে কে ভুল বলছে আর কে ঠিক সেটা নিজেরা বোঝার মত অবস্থায় এরা কখনোই পৌঁছায় না। এদের দেখলে আমার খুব নিচের পংক্তিদ্বয়ের কথা মনে হয়-


”দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি।
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’

পর্ব ৬

‘সতর্কীকরণ কালচার’ এর যে বাই প্রোডাক্ট এর ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় আপত্তি সেটা হচ্ছে কে ভুল আর কে ঠিক সেটা নিজেরা বোঝার মত ক্ষমতা না থাকা প্রজন্ম তৈরি হওয়া। যেহেতু এর মাধ্যমে আমরা বাইনারী চিন্তাভাবনার (হয় কারো সব কথা শোনা যাবে, না হয় কিছুই না) প্রসার ঘটাই, তাই কারো অবস্থান বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিশ্লেষণ করার দক্ষতাটা চলে যায়। একটা সমসাময়িক উদাহরণ দেই। টেন মিনিট স্কুলের সাম্প্রতিক ঘটনাটা চিন্তা করুন (যদিও এটা নিয়ে আমার পরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে ইনশাল্লাহ)। আসুন প্রথমে আমরা ঘটনা প্রবাহটা চিন্তা করি-

১) তুমুল জনপ্রিয় এই স্কুলের সাথে জড়িত একজন ফেসবুকে রংধনুর ছবি দিলো যে সে অক্সফোর্ডের যেসব ব্যাপার নিয়ে সে গর্বিত/ ভালবাসে, তার মাঝে একটা হল সমকামী অধিকারের পরিবেশ।

২) এটা নিয়ে চরম সমালোচনা শুরু হল, অন্য আরো যেসব ভিডিও কন্টেন্টে আপত্তিকর মন্তব্য আছে সেগুলো সামনে আসলো………

৩) টেন মিনিট স্কুলের সবাইকে এক ধারসে সমকামী লেবেল দিয়ে ভিডিও বানানো হয়ে গেলো………

৪) ইসলামে সমকামিতার অবস্থান নিয়ে ফেসবুকে ঝড় উঠলো। যারা এভাবে সমকামিতাকে নিয়ে হইচই করার সমর্থন করছেন তারা হুদুদ আইন নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিলেন।সেই সাথে কী হল? পশ্চিমা একাধিক দা’ঈ, স্কলারের মুণ্ডপাত শুরু হল যে উনারা সমকামিতাকে সাপোর্ট দিচ্ছেন, অতএব তাদেরকে বর্জন করতে হবে।আর যারা এই এপ্রোচটাকে সমর্থন করেন নাই, তারা বলতে লাগলেন যে সুদ, শিরক এগুলো তো আরো বড় গুনাহ, মাদ্রাসায় এসব বহু বছর ধরে চলে……এগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে ইত্যাদি। দুই পক্ষের কেউই অপর পক্ষের দাবী মানতে রাজি নয়। সেই আমিত্ব, যেটার কথা আমি বারবার বলে আসছি।

আমি চুপচাপ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কিভাবে আমরা ফোকাস হারিয়ে ফেলছি।

প্রথমত: আমাদের বুঝতে হবে, তরুণ প্রজন্মের কাছে কোনটা এখন ‘স্মার্টনেসের লক্ষণ’। সমকামীতাকে সাপোর্ট করা যে এখন ‘স্মার্টনেসের লক্ষণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, সেটার মেকানিজম আমাদের বুঝতে হবে। কিভাবে এই Gradual desensitization হল সেটা আমাদের বুঝতে হবে ও সেটা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। (এটা নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু অবজারভেশন আছে যেটা পরে শেয়ার করবো ইনশাল্লাহ।)

দ্বিতীয়ত:  আমাদের বুঝতে হবে যে পশ্চিমা দেশগুলোতে আর বাংলাদেশে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সেটআপে কাজ করছি। পশ্চিমা দেশগুলোতে এটা এখন ‘Pride’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাজ প্রায় সুসম্পন্ন। সেজন্য আপনি লাইব্রেরীগুলোতে গেলেও দেখবেন যে Unisex Wash room, All gender Wash room ইত্যাদি। এই সেটআপে বসে কেউ যখন LGBQT নিয়ে কথা বলবে, সেটা কোনোভাবেই আমাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এই বিশ্বায়নের যুগে আমি সবার সব টপিকের কথাই শুনতে পারি কিন্তু কোনটার অডিয়েন্স আমি না এইটা বুঝাটা অসম্ভব জরুরী। তা না করে আমি যদি পশ্চিমা দা’ঈদেরকে নির্বিচারে খারিজ করতে থাকি, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী, কারণ উনারা এমন কিছু ভালো কাজ করছেন যেটা স্থানীয় স্কলাররা করছেন না। এই সত্যগুলো আমাদের মেনে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে কোন জায়গায় এসে স্থানীয় স্কলারের দিক নির্দেশনার কোনো বিকল্প নাই।

তৃতীয়ত: বাংলাদেশে আমরা যে আন্দোলন করতে চাচ্ছি সেটার রূপরেখাটা স্পষ্ট হওয়া খুব জরুরী। আমরা কী চাচ্ছি? আমরা চাচ্ছি এটা যেন 3rd একটা অপশন হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা না পাক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য হুমকি। চিন্তা করুন আপনি মেয়ে হিসেবে একটা মেয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন, ঢোকার পর বুঝলেন যে সে লেসবিয়ান। আপনি মেয়েদের বাথরুমে গেলেন, রিল্যাক্স হলেন, হঠাত একটা ছেলে আসলো, হেসে বললো আমি গে, চিন্তা করো না! আসলে যে কেউ মেয়েদের প্রাইভেট জায়গায় ঢোকার জন্য এমন ভেক ধরছে না তার কি গ্যারান্টি? আমার ফ্রেণ্ড ছিলো যে তার মেয়ে রুমমেটের সাথে পর্দা করে চলতো কারণ সে ছিলো লেসবিয়ান 🙁

এই ব্যাপারটা না বুঝে আমরা যদি এটাকে স্রেফ একটা গুনাহ হিসেবে উপস্থাপন করি এবং সুদ, শিরকের এসবের সাথে তুলনা করি, আমরা ফোকাস হারাবো এবং আমাদের আলোচনা ভুল দিকে মোড় নিবে। আমরা বলা শুরু করবো কোনটা বড় গুনাহ- রিবা নাকি সমকামিতা ইত্যাদি নানা কথা।

চতুর্থত: একজন মুসলিম সবসময় যে কোনো একটা সমস্যা প্রোডাক্টিভ উপায়ে এপ্রোচ করার চেষ্টা করবে। আমাদের এখন যেটা সবচেয়ে বেশী দরকার সেটা হচ্ছে কারো যদি এই সমকামী টেন্ডেন্সী থাকে তাহলে তার কাউন্সেলিং, ট্রিটমেন্ট এগুলোর ব্যবস্থা করা, সফলতার কাহিনীগুলো বেনামে প্রচার করা। হেল্প লাইনের ব্যবস্থা করা, সাইকোলোজিস্টদের এগুলোর সাথে জড়িত করা।

কিন্তু আমরা কী করছি? টেন মিনিট স্কুল বর্জনের ডাক দিচ্ছি ঠিক যেভাবে পশ্চিমা দা’ঈদের বর্জনের ডাক দিয়ে এসেছি।

আমি আগের পর্বেও বলেছি, আবারো বলছি। মানুষের সাইকোলোজি বুঝতে হবে। মানুষকে যেটা করতে না করবেন, সে সেটা আরো বেশী করে করবে। মানুষকে সময় দিতে হয়। মানুষকে মুখের উপরে যদি বলতে থাকেন তুমি ভুল স্কলারের কথা শুনতেসো, লাভ খুব কম হয়। তাকে বিকল্প দেয়াটা খুব জরুরী। টেন মিনিট স্কুলের কার্যকর বিকল্প কি আমাদের আছে?

আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের উদ্দেশ্য মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা, ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করা না। আমরা কারো ব্যাপারেই আশা হারাবো না। সে সমকামীতাকে সাপোর্ট করা ইন্সট্রাক্টর হোক আর তাদেরকে রোল মডেল মনে করাকে টিনএজ প্রজন্ম হোক- সবার সামনেই ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরার মত দক্ষতা আমাদের থাকতে হবে।

আসলে আমরা খুব অলস জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের আলস্য আমাদেরকে সহজ পথে ডাকছে- সবাইকে খারিজ করে দেয়া। বিকল্প কিছু তৈরি করা সব সময়ই কঠিন।

শেষ পর্ব



আচ্ছা আমি কি তাহলে এই ‘সতর্কীকরণ কালচার’ পুরোপুরি বাদ দিতে বলছি?

যারা আমার নিয়মিত পাঠক, তারা জানেন যে ‘কোয়ান্টাম মেথড আমাদেরকে কোন পথে ডাকছে’ এই শিরোনামে আমার লেখা আছে, সূরা কাহফের সিরিজে আমি ইমরান নযর হোসেইনের নাম উল্লেখ করেছি ওনার দাজ্জাল সংক্রান্ত বক্তব্য যে ভুল সেটা বুঝাতে……

আমি তাহলে কি বলতে চাচ্ছি? আমিতো বারবার বলছি যে কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাহলে কেউ যখন আসলেই ভুল করবেন সে ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

১) প্রথমেই নিজের অন্তরের দিকে তাকানো উচিত। নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত-

আমার সাথে মতের অমিল হচ্ছে বলে তাকে খারিজ করে দিচ্ছি না তো? ধরেন আপনি মনে করেন পশ্চিমা সমাজে বসবাসকে অপছন্দ করেন।আপনি যে জনপ্রিয় দা’ঈ/ স্কলারকে খারিজ করছেন তার দোষ আদতে এটাই না তো যে উনি পশ্চিমা দেশে বাস করেন? কিংবা


আপনি আগে থেকে অপছন্দ করেন এমন কারো ভুল পেলে আপনার ভালো লাগছে কি? যদি ভালো লাগে তাহলে নিচের আয়াতটা আমাদের জন্য ভয়াবহ সতর্কবাণী-

আর তাঁদের সাথে অবর্তীণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুতঃ কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করেনি; কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষবশতঃ তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল। (২ঃ২১৩)

অর্থ্যাৎ আমাদের মাঝে যে বিভক্তি সেটার কারণ প্রমাণের অভাব নয় বরং পারস্পরিক হিংসা। তাই মুখে আমরা যাই দাবী করি না কেন তাহাজ্জুদে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সৎ সাহস আছে নাকি সেটা যাচাই করে দেখা। দিনের শেষে আমরা কিন্তু আল্লাহর সামনে একা দাঁড়াবো, একা হিসাব দিবো। তাই কিয়ামতের দিন যখন অন্তরের অবস্থা প্রকাশ্য হয়ে যাবে তখন যদি দেখা যায় আমার নিয়্যতে সমস্যা ছিলো তাহলে যাদের নামে বিষেদগার করেছি তারা তো এসে আমার ভালো কাজ নিয়ে যাবে। ব্যাপারটা খুব ভীতিকর না?

২) সতর্ক করার আগে বক্তাকে মুসলিম ভাই হিসেবে Benefit of Doubt দেয়া, তার জন্য অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করা। শোনা কথার উপর ভিত্তি না করে নিজে ভালো মত যাচাই করা যে বক্তা আসলে কী বলেছেন বা করেছেন, সেটা নিয়ে বৈধ ফিকহি মতভেদ আছে নাকি, আমরা যা ভাবছি উনি আসলেই সেটা বুঝিয়েছেন কী না, উনি যে পরিবেশে কথা বলছেন সেটার ব্যাপারে আপনার কোনো সম্যক ধারণা আছে কী না…ইত্যাদি। সেটা যদি না করা হয়, তাহলে যারা ওই বক্তাকে অনুসরণ করে তারা সতর্ককারী ভিডিও শুনেই বুঝবে যে বক্তার ব্যাপারে ঠিক মত না জেনেই মন্তব্য করা হচ্ছে। তখন উলটা সতর্ক করা ভিডিওটাই গ্রহণযোগ্যতা হারাবে, বরং হিতে বিপরীত হবে। মানে ওই বক্তার ভুলগুলো তুলে ধরে বলা সব সতর্ককারী ভিডিওই তার ভক্তরা উপেক্ষা করবে, তখন উনি বিশাল ভুল করলেও সেটা ধরিয়ে দেয়ার সব প্রচেষ্টা বিফলে যাবে, কারণ পান থেকে চুন খসলেই ভিডিও বানিয়ে আগেই গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।

৩) কোনো স্কলার বা দা’ঈ যদি তুমুল জনপ্রিয় হয়, সেটার কারণ বোঝার চেষ্টা করা এবং তার ভক্তদের আবেগের মূল্যায়ন করা। আজকালকার তরুন প্রজন্ম খালি ইংরেজী বক্তাদের লেকচার শোনে, দেশীয় আলেমদের পাত্তা দেয় না ইত্যাদি ঢালাও মন্তব্য না করে বোঝার চেষ্টা করা উচিত এরা এমন কোনো শুন্যস্থান পূরণ করছে নাকি যেটা দেশীয় আলেমরা পারছে না।

এই ব্যাপারটা টেন মিনিট স্কুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদেরকে ভ্যালু ক্রিয়েট করতে জানতে হবে এবং সেটা করতে পারতে হবে। এটা আমি কোয়ান্টাম মেথডের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করার সময় খেয়াল রাখি। আমি স্বীকার করি যে আমাদের সমাজে প্রচলিত ইসলাম মানুষের আত্মার খোরাক হতে পারছে না বলেই মানুষ এসবের দিকে ঝুঁকছে। যতদিন না আমরা সেই সেই শুন্যস্থান পূরণ করতে পারবো, ততদিন এসব সতর্কীকরণ বক্তব্য নিষ্ফল রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

৪) একান্তই যদি কারো নাম ধরে কিছু বলতেই হয় (ক্ষেত্র বিশেষে সেটা খুবই জরুরী হয়ে পড়ে) তাহলে ভাষা সংযত ও শালীন হওয়া বাঞ্চনীয়। মুখের ভাষা থেকে যদি দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে তাহলে সেই বক্তব্য এমনিতেই মানুষকে ছিটকে দেয়। তখন এমন মনে হওয়া বিচিত্র না যে আমার সম্মান আমার মুসলিম ভাইদের চেয়ে কাফিরদের কাছে বেশী নিরাপদ!

৫) সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা ব্যক্তি কেন্দ্রিক সমালোচনাকেই অভ্যাসে পরিণত না করে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগুলো প্রচারে মনোযোগ দেই, সেটা দীর্ঘমেয়াদে অনেক বেশী কার্যকরী হবে। যেমন সমকামিতা কেন একটা ভয়ংকর ব্যাপার, কেন এটা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি, যারা এটাকে হালকা করে দেখছেন তাদের যুক্তির অসারতা, কেন আমরা এগুলোকে অন্যান্য গুনাহের সাথে তুলনা করে হাল্কা করে ফেলবো না ইত্যাদি। ঠিক একই ভাবে ইমরান নযর হোসেনের আমল নামা বিশ্লেষণ না করে আমাদের উচিত হাদীস ব্যাখ্যা করার উসূল বা মূলনীতিগুলো খুব সহজ ভাষায় মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। এগুলো যদি মুসলিমদের মাঝে ব্যসিক জ্ঞান করার প্রচেষ্টা চালাই তাহলে উনার দাজ্জালিক ব্যাখ্যায় আর কেউ বিভ্রান্ত হবে না ইনশাল্লাহ। বিস্তারিত আছে https://bit.ly/3cB9R8O এবং https://bit.ly/3gZ5I1G এই লিংকে।

আচ্ছা এসব এত কথা কেন লিখছি? কারণ মূলত দুইটা। প্রথমত, আমি যারা দ্বীনে নতুন আসছে তাদের চোখে কনফিউশন দেখে খুব কষ্ট পাই। এক যুগ আগের অসহায় আমার কথা মনে পড়ে যায়। তাই যারা নতুন দ্বীনে এসেছেন তাদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ-

১) মুসলিমদের মাঝে এত অনৈক্য দেখে ইসলাম থেকে ছিটকে যাবেন না প্লিজ। আল্লাহর দ্বীন সুন্দর, আমরা এটার সৌন্দর্য নষ্ট করেছি, এটার দায়ভার আমাদের।

২) আপনার পরিচিত, বিশ্বস্ত কারো কাছ থেকে দ্বীন শেখা শুরু করুন, শুধু মাথায় রাখবেন সে আপনাকে যেন অন্ধ আনুগত্যের দিকে না ডাকে। ইসলামের অসংখ্য সৌন্দর্য্যের মাঝে একটা হচ্ছে এতে কোনো পুরোহিত তন্ত্র নেই। স্কলারদের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান অর্জন করবো অবশ্যই, তারা সম্মানের দাবীদার, কিন্তু তারা পূজনীয় নন।

৩) আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, একজন বান্দার হিদায়াতের পথে আসতে চাওয়ার আকুল দুআ আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেন না। আমরা যেন ভুলে না যাই যে সালাতে আমাদের আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলার দারুণ সুযোগ রয়েছে। তাই সারাক্ষণ জুজুর ভয় করার কিছু নেই যে এই বুঝি আমি অমুকের কথা শুনে পথভ্রষ্ট হয়ে গেলাম। শতভাগ সঠিক কারো পক্ষে হওয়া সম্ভব না, হলেও হিদায়াতের উপর মৃত্যু আমাদের কারো জন্যই গ্যারান্টিড না, সেজন্য আমৃত্যু চেষ্টা নিজেকেই করে যেতে হবে, আমার হিসাব আর কেউ দিয়ে দেবে না।

৪) শুধু একই ধরণের মানুষের মাঝে মিশবেন না, যারা আপনার সাথে খালি হ্যাঁ হ্যাঁ করে যায়। প্রাথমিকভাবে দ্বীনদার সংগের সাথে থাকা খুবই জরুরী কিন্তু দ্বীন পালন করছে না এমন আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথে মেশাও একেবারে বন্ধ করে দিবেন না। তাহলে আমার মত তাদের সাইক্যোলজি ভুলে যাবেন। আল্লাহর দ্বীনের দরজা যেন সবার জন্য খোলা থাকে।

এই লেখা লেখার দ্বিতীয় এবং মূল কারণ নিজেকে রিমাইণ্ডার দেয়া। এই সতর্কীকরণ কালচারটা আমাদের নিত্যদিনের সাথী হয়ে গেলে দিনের শেষে আধ্যাত্মিকতার লেভেল আশংকাজনকভাবে কমে যায়। আমি নিজে এটা অনুভব করেছি। ঘৃণার চাষ করতে করতে অন্তরটা আর নরম থাকে না, নামাজে মোটেই কান্না আসে না। এটা শুনতে সিম্পল মনে হলেও আসলে ব্যাপারটা খুব ভয়ের। কার জন্য করছি এসব? কিসের নেশায় করছি? যদি আমি নিজেই ঈমানী ক্ষতিতে পড়ে যাই?
আমার কাছে মনে হয়, একটা মানুষ যখন নতুন নতুন দ্বীনে আসে, তার পাপগুলোর কারণে অনুতাপে কাঁদে, কুরআন হাদীস বোঝার চেষ্টা করে, তখনো গভীর জ্ঞান অর্জন করেনাই, ওই অবস্থাটায়ই সে সবচেয়ে ভালো মুমিন থাকে, যদিও তার কাছে তখনও নিজেকে অনেক খারাপই মনে হয়। তারপর আস্তে আস্তে তার জানাশোনার পরিধি বাড়ে, বিশেষ কোনো ঘরানা বেশি পছন্দ হয় বা তাদের সাথেই কাজের তাওফীক বেশি পায়, পাপের কারণে প্রথম দিককার অনুতাপ আস্তে আস্তে কমে আসে, তখনই তার মধ্যে নতুন করে আরেক জাহেলিয়াত এসে যায়। সমস্যা হচ্ছে এই জাহেলিয়াতকে চেনাটাই একটা চ্যালেঞ্জ।


আর এখানেই সম্ভবত কুরআনের ভূমিকা। যেমনটা এই লেখার শুরুতে বলেছি, ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ, পথ চলার শুরু হয়েছিলো কুরআনের অর্থ পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমার দ্বীন শিক্ষার যাত্রা পথে একটা সময় আমি যেন কুরআনের সাথে নিবিড় সম্পর্কটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এটা সেই সময়ের কথা যখন ইসলামিক স্টাডিজ সিলেবাসের অংশ হিসেবে আমি শুধুই সেকেণ্ডারী টেক্সট পড়তাম। সেকেণ্ডারী টেক্সট বলতে আমি ইসলামিক বইই বুঝাচ্ছি, তবে যেগুলো মানুষের লেখা। সেগুলো অবশ্যই উপকারী কিন্তু আত্মশুদ্ধির জন্য সবসময় উপকারী নয়। সেজন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে কুরআনের কাছে, যেতেই হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আমরা যদি ইসলাম সঠিকভাবে অনুসরণের ব্যাপারে আন্তরিক হই তাহলে সাময়িকভাবে ভুল স্কলারের অনুসরণ করলেও ব্রেনে একটা রেড অ্যালার্ম বাজতে থাকবে যে কোথাও ভুল হচ্ছে। এই একনিষ্ঠতাই আমাদের রক্ষা করবে সেলিব্রেটি কালচার থেকে কিংবা ফতওয়া শপিং থেকে। এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিয়মিত আল্লাহর কাছে ফুরক্বান (সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা) চাওয়া আর ইস্তেগফার (ক্ষমা চাওয়া) করা। নিচের দুআটা যেন আমাদের ব্রেনের কোষে কোষে গেঁথে যায় –

হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করোনা এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা। (৩ঃ৮)

যা কিছু বলেছি তার মাঝে যদি ভালো কিছু থেকে থাকে তবে সকল প্রশংসা আল্লাহর, যদি ভুল কিছু বলে থাকি তবে তার পূর্ণ দায়ভার আমার। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।

(এই পর্বের শেষের কিছু অংশ এক বোনের কমেন্ট থেকে তার অনুমতিক্রমে হুবহু কপি করা হয়েছে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন, আমার মনের কথাগুলো গুছিয়ে বলার জন্য)


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন