ইমাম মাহদীর অপেক্ষায়……আমাদের করণীয়

লেখাটি শেয়ার করতে পারেন

ভূমিকা:

কিছুদিন পর পরই আমরা দেখি বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেকে ইমাম মাহদী হিসেবে দাবী করছে কিংবা দাজ্জাল চলে এলো বলে নানা সতর্কবাণী/ ভবিষ্যৎ বাণী প্রচার করা হচ্ছে। অমুক ব্যক্তিই মাহদী বা সব কিছুই দাজ্জালের আগমন ত্বরান্বিত করার প্ল্যাটফর্ম-এই ধরণের কথাবার্তা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। অন্যদিকে যেসব স্কলার এগুলোকে ভিত্তিহীণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তাদের জনপ্রিয়তার পারদ অনেক নিচে, ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে প্রচুর অপদস্থ হতে হয়।

কে/কারা সঠিক? ইমাম মাহদী বা দাজ্জালের আগমনের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন হওয়া উচিৎ? কুরআন ও সুন্নাহ আমাদেরকে কী জানায়?

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই বিষয় নিয়ে স্কলারলি রিসোর্স বাংলায় খুবই অপ্রতুল। কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব এককথায় অনস্বীকার্য। তাই মুবাশ্বেরা সিস্টার্সের এবারের আয়োজন একটা ছায়া অনুবাদ। এজন্য আমি বেছে নিয়েছি বর্তমান সময়ের বিদগ্ধ আলেম শেখ সালমান আল আওদাহ এর বুকলেট- ‘Awaiting The Mahdi: Covenant or Creed’। ছায়া অনুবাদ বলছি এজন্য যে আমি হবহু পুরাটা আক্ষরিক অনুবাদ করবো না, বরং বুকলেটের ‘থিম’ বা মূল ভাব আমাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরবো ইনশাল্লাহ। ।

লেখাটা আমার অসম্ভব প্রিয়। এটা আমি প্রথম পড়ি সেই ২০১১ সালের দিকে। তখন আমি নিজেই ‘পবিত্র কুরআনে জেরুজালেম’ বইটার মূল প্রণেতার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলাম, নিয়মিত Arrivals এর পর্ব দেখতাম। আমার এহেন অবস্থা দেখে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে এই লেখাটা পড়ার পরামর্শ দেন। সত্যি কথা হল, লেখাটা পড়ে আমি দারুণ চমকে যাই। কারণ লেখাটার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা একদম হাতে ধরে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ‘কোন মানসিকতা’ থেকে দুদিন পর পর এমন বিষয়গুলো নিয়ে আমরা মুসলিমরা ব্যস্ত হয়ে যাই। তাই এই অনুবাদে ক্ষেত্র বিশেষে আমি আমার নিজের ‘Observation’ উল্লেখ করবো যেটার উদ্দেশ্য হবে একজন স্কলার একটা বিষয় কিভাবে ব্যবচ্ছেদ করেন সেটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ইসলামী জ্ঞানের পথে যাত্রায় একদম ‘Novice’ আমার কাছে এই ব্যাপারটা আনকোরা নতুন ছিলো, কিন্তু আজো এটা আমার কাছে ঠিক তেমনই আকর্ষণীয় লাগে যেমনটা Day 1 এ লাগতো।

বিঃদ্রঃ
১। লেখাটা আক্ষরিক অনুবাদ করে আমার কাজটা অর্ধেক সহজ করে দিয়েছে সুমাইয়া আখতার নামে এক ছোট বোন, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
২। দাজ্জালের ‘One Eyedness’ বলতে আসলে কী বোঝায় সেটা তুলে ধরার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম ‘রামাদ্বান কাটুক সূরা কাহফের সাথে’ শীর্ষক সিরিজে। আমাদের পেইজের Photos সেকশনে গেলে এটা খুঁজে পাবেন ইনশাল্লাহ। আমার খুব প্রিয় একটা লেখা, বর্তমান সিরিজটার পাশাপাশি ওটা পড়ারও অনুরোধ থাকবে।

পর্ব ১

শুরুতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই শাইখের Approach বা Methodology এর ব্যাপারে। এই যে আমরা অধীর আগ্রহে ইমাম মাহদীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছি বা কে ইমাম মাহদী সেটা চিহ্নিত করতে দারুণ উৎসুক, আমাদের এই Attitude টা কি সঠিক? সেটা বের করার জন্য শাইখ সালমান ফিরে যাচ্ছেন কুরআনের কাছে। কুরআনকে জিজ্ঞেস করছেন এই প্রশ্নটা, কারণ সেটাই সবচেয়ে বিচক্ষণ উপায় এবং কুরআনেই রয়েছে সকল যুগের সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু কিভাবে তিনি কুরআনের শরণাপন্ন হচ্ছেন?

তিনি দেখছেন যে এই ‘অপেক্ষা করা ‘ ক্রিয়াটা কুরআনে কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি কুরআনের এমন প্রতিটি আয়াত নিয়ে গবেষণা করলেন যেখানে ‘অপেক্ষা করা’ শব্দটি কিংবা তার প্রতিশব্দ রয়েছে। তার পর্যবেক্ষণ অনুসারে এ ধরনের আয়াতগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়ঃ

প্রথম শ্রেণিঃ যে আয়াতগুলোতে অবিশ্বাসীদের অপেক্ষা করতে বলা হয় মৃত্যুপরবর্তী জীবনে শাস্তির জন্য। যেমন নিচের আয়াতটিঃ

আর তারা বলেঃ তোমরা যদি সত্যবাদী হও তাহলে বল, এ ফয়সালা কখন হবে? বল, ফয়সালার দিনে (সব কিছু দেখার পর) কাফিরদের ঈমান আনয়ন তাদের কোন উপকার দিবে না, আর তাদেরকে কোন সময়ও দেয়া হবে না।কাজেই তুমি তাদেরকে এড়িয়ে চল আর (আল্লাহর ফয়সালার জন্য) অপেক্ষা কর, তারাও (সেই ফয়সালার জন্য আছে) অপেক্ষমান।” ( সূরা সিজদা ২৮-৩০)

অনুরূপ আরেকটি আয়াত হচ্ছে, “… যেদিন আপনার রবের কোন সুনির্দিষ্ট নিদর্শন আসবে, সেদিন এমন কোন ব্যাক্তির ঈমান কাজে আসবে না যে ব্যাক্তি নেক কাজ করেনি। বলুনঃ তোমরা প্রতীক্ষায় থাক, আমিও প্রতীক্ষায় রইলাম।“ (সূরা আল আনআমঃ১৫৮)

এই সুনির্দিষ্ট নিদর্শন হতে পারে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠা বা ব্যক্তিবিশেষের জন্য মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হওয়া যখন তার সামনে থেকে গায়েবের পর্দা সরিয়ে দেয়া হবে। এই সময়গুলোতে আল্লাহকে বিশ্বাস করতে শুরু করা কোন কাজে আসবে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, এখানে “অপেক্ষা করা” মানে এই নয় যে কোন কিছু ঘটার আশায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা বরং যা ঘটার ভয় করা হচ্ছে তার আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেন যে ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে তার মুখোমুখি না হতে হয়।

দ্বিতীয় শ্রেণিঃ সেই আয়াতগুলো যেখানে অবিশ্বাসীদের এই দুনিয়াতেই তাদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার জন্য ভীতিপ্রদর্শণ করা হয়েছে। কখনও কখনও অবিশ্বাসীরা খুব তাড়াহুড়া করে তাদের পরিণাম দেখার জন্য যেহেতু তারা তা বিশ্বাস করে না এবং শাস্তির ব্যপারে সচেতন নয়।

হুদ আলাইহিসসালামের সাথে তাঁর ক্বওমের কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে নিচের আয়াতেঃ

কাজেই তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে আমাদেরকে যে জিনিসের ওয়াদা করছ (ভয় দেখাচ্ছ) তা নিয়ে এসো। সে বলল, ‘তোমাদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের অসন্তোষ ও ক্রোধ নেমে এসেছে। তাহলে তোমরা কি আমার সঙ্গে এমন কতকগুলো নাম সম্পর্কে বিতর্ক করছ যেগুলোর নামকরণ তোমরা আর তোমাদের বাপ-দাদারাই করেছে যে সম্পর্কে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাযিল করেননি? তাহলে তোমরা অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সঙ্গে অপেক্ষমান থাকলাম।’(সূরা আরাফ:৭০-৭১)

তারা শাস্তি আহ্বান করলো, অনুরোধ করলো তা ত্বরান্বিত করার জন্য এবং তাদের অপেক্ষা করার জন্য নির্দেশ দেয়া হল। অনুরূপ আয়াত আছে সূরা ইউনুস:১০২, সূরা আরাফ:৮৭ এবং সূরা তুরঃ ৩১ নং আয়াতে। তবে এ সংক্রান্ত নিচের আয়াতটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

যারা ঈমান আনে না তাদেরকে বল, ‘তোমরা নিজেদের মত ও পথে থেকে কাজ করে যাও, আমরা (আমাদের) কাজ করছি।আর তোমরা অপেক্ষা করো,আমরাও অপেক্ষায় থাকলাম। (সূরা হুদ:১২১-১২২)


কেন এই আয়াতটি বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার? কারণ এখানে অপেক্ষা এবং কাজ কে পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে। অবিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে তোমরা তোমাদের নিজেদের মতের উপর কাজ করে যাও, আর আমরা আমাদের মতের উপর কাজ করি এবং আপেক্ষা করি যে আল্লাহ আমাদের উভয়ের মধ্যে কি ফয়সালা করেন তার জন্য।

তৃতীয় শ্রেণীঃ এই আয়াতগুলোতে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত কোন নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে।

অবিশ্বাসীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন একটি নিদর্শন নিয়ে আসার কথা বলত। অন্যান্য আরও অনেক দাবীর মধ্যে তারা চেয়েছিল সাফা পর্বত তাদের জন্য স্বর্ণে রূপান্তরিত হোক অথবা এক টুকরো আকাশ তাদের উপর পড়ুক। যেমন নিচের আয়াতটিঃ

“তারা বলে, ‘‘তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে কোন নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন?’’ এদের জবাবে বলে দাও, ‘‘অদৃশ্য জগতের একচ্ছত্র মালিক হলেন আল্লাহ, কাজেই তোমরা অপেক্ষা কর (এবং ভবিষ্যতে কী হয় দেখ), আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষমান থাকলাম।”(সূরা ইউনুসঃ২০)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অপেক্ষা সংক্রান্ত আয়াতগুলো থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই?

পাঠকদের কাছে অনুরোধ থাকবে নিজে নিজে চিন্তা করার, আমরা আগামী পর্বে নিয়ে আসবো শাইখের করা পর্যবেক্ষণ, যা বুকলেটটিতে উল্লেখিত হয়েছে

পর্ব ২


যেহেতু এই সিরিজটা একটা ছায়া অনুবাদ, তাই আমি প্রথমে আয়াতগুলোর ব্যাপারে শাইখ সালমান কী বলেছেন সেটা উল্লেখ করবো, ক্রম এবং ভাষা কিছুটা পরিবর্তন করে। তবে তারপর আয়াতগুলো পড়ে আমার নিজস্ব কিছু উপলব্ধি যোগ করার লোভ মনে হয় না সংবরণ করতে পারবো।

১। আগের পর্বে উল্লেখিত তিন প্রকারের আয়াত থেকে আমরা প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা পাই সেটা হল-
বসে বসে অপেক্ষা করা এবং প্রত্যাশা করার স্থান কুরআন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর কোথাও নেই। এমনকি কেয়ামাতের জন্যও নয়। বরং আয়াতগুলোতে অপেক্ষা করাকে একধরণের সতর্কবাণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন শেষ মুহুর্ত চলে আসার আগেই আমরা ঈমান আনয়ন এবং সৎ কর্ম করতে পারি। তাই ‘অপেক্ষা’ এবং ‘কাজ করে যাওয়াকে’ Mutually Exclusive হিসেবে ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

এই প্রসঙ্গে আমার অসম্ভব প্রিয় একটা হাদীস হচ্ছে নিচেরটা-
আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের কারো হাতে যদি একটি খেজুরের চারা থাকে এবং সে অবস্থায় কেয়ামাত সংঘটিত হয় তবে সম্ভব হলে সে যেন তার নিজের জায়গা থেকে উঠার আগে তা রোপন করে নেয়।“ [মুসনাদ আহমাদ (১২৯৮১)]

এই হাদীস থেকে শাইখ সালমানের Take away হচ্ছে এখানে তোমরা কেউ নামায পড়তে থাকলে সেটা শেষ করো এমন বলা হয় নাই, বরং গাছ লাগানোর মত একটা বিষয় বলা হয়েছে যেটা আপাত দৃষ্টিতে দুনিয়াবী কাজ মনে হবে। তার মানে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা যে কোনো ধরণের কাজই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত করে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের উৎসাহিত করা হয়েছে। সেটা হতে পারে অসহায় এবং নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো বা শিশুদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়া অথবা অভাবগ্রস্ত ও ক্ষুধার্তকে দান করা। তাহলে একজন মানুষের কাজের আরও কত বেশি পুরষ্কার দেয়া হবে যদি তা ধর্মীয় উপকারের জন্য হয়? আর যদি কাজটা এমন হয় যে কাউকে সুপথ প্রদর্শনের চেষ্টা করা যে বিপথে চলে গিয়েছে আথবা অবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছে কিংবা মুসলিমকে ধর্মীয় শিক্ষা দান করা যে তার ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাওয়া মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা করা? সেসব কাজের ব্যাপারে আমাদের কতটা সিরিয়াস হওয়া উচিৎ সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি?

প্রত্যাশিত কোনো কিছু ঘটবে এই আশায় বসে থাকা সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে একধরনের অলসতা ও নিশ্চেষ্টতা নিয়ে আসে যা তাদের জড়তাগ্রস্ত করে ফেলে। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে ইসলামে কাজের গুরুত্ব অত্যাধিক, ইসলাম ঈমানদারদের পরিশ্রমী হবার শিক্ষা দেয়।

কিয়ামত চলে আসলেও গাছ লাগানো শেষ করার হাদীসের যে বিষয়টা আমাকে (অনুবাদক) দারুণভাবে মুগ্ধ করে তা হল ‘করে কী হবে’ এই প্রশ্ন না করার মানসিকতাকে উদ্বুদ্ধ করা। চিন্তা করুন, আপনি আমি যদি এই হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুনতাম তাহলে প্রথমেই কি এই প্রশ্ন করতাম না যে কিয়ামত এসে যেতে ধরলে গাছ লাগায়ে কী হবে? এই হাদীস থেকে আমি বুঝি যে আমরা চেষ্টা করেছি কী না শুধু সেইটুকুর জন্য দায়িত্বশীল, ফলাফলের জন্য না। মুসা আলাইহিস সালামের সাগরে লাঠি দিয়ে আঘাত করা, হাজর আলাইহিস সালামের সাফা মারওয়ার মাঝে ছোটাছুটি, এই প্রত্যেকটা ঘটনাতে আমি শুধু এই ব্যাপারটাই দেখতে পাই- মিরাক্যল বা আল্লাহর সাহায্য আসবে, তবে সেটা আমার সামর্থ্যের মাঝে যেটুকু কুলায় তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করার পর। করে কী হবে এটা মূলত বনী ইসরাইলের স্বভাব, যেমনটা তারা মুসা আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করেছিলো যে গরু জবাই করে কী হবে, মানে গরু জবাই এর সাথে কে হত্যাকারী এটা জানার কী সম্পর্ক! ( আমি ওই ঘটনার বিস্তারিত এখানে দিচ্ছি না প্রাসঙ্গিক না বিধায়)। তবে এই হাদীস হৃদয়ঙ্গম করার পর থেকে আমার জীবনের লক্ষ্য একটাই, যে কোনো পরিস্থিতিতে এটা নিশ্চিত করা যে আমি যেন আল্লাহকে গিয়ে বলতে পারি যে I gave my best, My lord

 পর্ব ৩



১ম পর্বে উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে আর একটা শিক্ষণীয় হচ্ছে- আল্লাহর শাস্তি কখন আসবে বা দাজ্জাল/ ইমাম মাহদী কখন আসবে এটা নিশ্চিতভাবেই গায়েবের জ্ঞান যেটা আল্লাহ আমাদের কাউকে জানান নি। এই গোপন রাখার ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত এবং এটার মাঝে গভীর প্রজ্ঞা বিদ্যমান।

আল্লাহ বলেনঃ “কিয়ামাত আসবেই, আমি তা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় চেষ্টা-সাধনা অনুপাতে ফল লাভ করতে পারে।”(সূরা তাহা:১৫)
সত্যি কথা হচ্ছে আমি (অনুবাদক) যখন বিভিন্ন ব্যক্তিদের বিপুল সংখ্যক ফ্যান ফলোয়ারের গল্প শুনি যারা স্রেফ ভবিষ্যৎবাণী করছেন তখন Honestly আমার খুব অবাক লাগে। কিভাবে এরকম ভবিষ্যৎ বলা মানুষদের আমরা আইডল হিসেবে গ্রহণ করতে পারি? ব্যক্তিগতভাবে এগুলো কাছে আমার অলস মানুষদের একধরণের ছুতা মনে হয় যারা স্রেফ দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল খুঁজতে থাকেন।

যাই হোক, এ প্রসঙ্গে শাইখ সালমান আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে আল্লাহর নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম, যার কাছে আল্লাহর ওহী নাজিল হয়েছিল, তিনিও দৃঢ়তার সাথে তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেননি বরং অনুমান করেছিলেন মাত্র।

তাদের দুজনের মধ্যে যে জন মুক্তি পাবে বলে সে (ইউসুফ) মনে করল তাকে বলল, ‘তোমার প্রভুর কাছে আমার সম্পর্কে বলিও।’ কিন্তু শয়তান তাকে তার প্রভুর কাছে ইউসুফের কথা উল্লেখ করতে ভুলিয়ে দিল। (সূরা ইউসুফ:৪২)

একইভাবে, যখন একজন লোক রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট এলো এবং তার একটি স্বপ্নের বর্ণনা করলো। আবু বকর (রাঃ) তার ব্যাখ্যা করলেন এবং জানতে চাইলেন,” হে আল্লাহর রাসূল, আমি কসম করছি যে আপনি আমার পিতৃতুল্য। আমি কি এটা ভুল বলেছি নাকি সঠিক বলেছি?”

আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “ তুমি কিছু অংশ ভুল বলেছ এবং কিছু অংশ সঠিক বলেছ।“ আবু বকর বললেন, “ আল্লাহর কসম, আপনি আমাকে বলে দিন আমি কোন অংশ ভুল বলেছি।“

আল্লাহর রাসুল (সঃ) বললেন, “কসম করো না” [ সহীহ বুখারী (৭০৪৬) এবং সহীহ মুসলিম (২২৬৯)]


আচ্ছা এই যদি আল্লাহর নবী এবং রাসূল )সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে)র সামনে উপস্থিত সবচেয়ে প্রিয় সাহাবীর অবস্থা হয় তাহলে আজকের সময়ের কোনো সাধারণ মানুষ বা আলিমের ব্যাপারে কী বলা যায়? আমাদের বুঝতে হবে যে প্রত্যাশা, সম্ভাবনা, স্বপ্ন, আশা এগুলোর ব্যাপারে অনেক প্রশস্ততার সুযোগ রয়েছে কিন্তু কাউকে এসব ব্যাপারে কোন প্রকার নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না যেহেতু এগুলো পুরোপুরি গায়েবের সাথে সংশ্লিষ্ট।

তৃতীয় লক্ষণীয় বিষয় এই যে যখনই কেউ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে জিজ্ঞেস করেছে কিয়ামত কখন বা আল্লাহর শাস্তি কোথায়, আল্লাহ তাকে এই মর্মে জবাব দিতে বলেছেন যে গায়েবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই। মানে এ ব্যাপারে কোন মানুষ এমনকি নবীদেরও সম্পৃক্ত করেননি। এ সমস্ত ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার এখতিয়ারে এবং তিনি এগুলো তার কোন সৃষ্টির সাথে আলোচনা করেন না, তাই এ ব্যাপারে মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর ফায়সালা মেনে নিতে হবে, তাঁর ইচ্ছে ও আদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। মানুষ অবশ্যই সেসব ব্যাপার নিয়ে অনুসন্ধান করবে না যেগুলো তাদের এখতিয়ারে নেই।

আচ্ছা আমরা কি এই শেষ মুহূর্তটি এগিয়ে আনার জন্য তাড়াহুড়াও করতে পারি?

উত্তর হচ্ছে “না”। এ ব্যাপারে বুকলেটটি শাইখ সালমান আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময়ের একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন যেখানে কুফায় এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এক লোক উনার কাছে এসে মন্তব্য করলো যে কিয়ামত এসেই পড়লো বুঝি। শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু হেলান দেয়া থেকে বসে গেলেন, (এটা হতে পারে উনি কথাটা শুনে সচকিত হলেন বা খুব বিরক্ত হলেন/ রেগে গেলেন) তারপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছ থেকে শোনা হাদীস উল্লেখ করে বললেন যে, কিয়ামত আসবে না যতক্ষণ না অমুক অমুক ঘটবে। অর্থ্যাৎ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ঐ লোকের এহেন তাড়াহুড়া এবং দ্রুত উপসংহারে পৌঁছে যাওয়ার নীতি খুব অপছন্দ করলেন।

বুকলেটে উল্লেখিত শিক্ষাগুলোর এখানেই সমাপ্তি। এখন আমি আমার কিছু অনুভূতি শেয়ার করতে চাই। এই ছায়া অনুবাদের কাজটা করতে গিয়ে যে আয়াতটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছে তা হল সূরা হুদের ১২১-২২ আয়াত
যারা ঈমান আনে না তাদেরকে বল, ‘তোমরা নিজেদের মত ও পথে থেকে কাজ করে যাও, আমরা (আমাদের) কাজ করছি। আর তোমরা অপেক্ষা করো, আমরাও অপেক্ষায় থাকলাম।’’

সাম্প্রতিক সময়ে আমি প্যালেস্টাইন ইস্যুতে একাধিক ওয়েবিনার নিয়েছি এবং এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের করণীয়র ব্যাপারে প্রথমে বলেছি যে আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পারেন না যে আমি হামিদা যদি বাংলাদেশ/USA তে বসে একজন ভালো মুসলিম হই তাহলে কিভাবে প্যালেস্টাইনের ভাই বোনদের সাহায্য করা হবে। এটা আমরা বুঝি না কারণ আমরা জানি না আল্লাহর সাহায্য কিভাবে আসে, আমরা জানি না যে আমরা কিভাবে নিজেদের দোষে প্যালেস্টাইনকে হারিয়েছি, আমরা জানি না যে কত বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচর, ডাবল এজেন্টদের হাত আমাদের প্যালেস্টাইনের ভাইদের রক্তে রঞ্জিত।
আমরা যখন দুনিয়ার জীবনের স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে আখিরাতকে বেঁচে দিবো না, ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করবো না, তখনই আমরা বড় Ideology র জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারবো। এই যে আমরা যে কোনো কিছুকে ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেই, আমরা কি একবারো ভাবি যে ওরা ওদের Ideology প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক?

রাসূল( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সময়ে কি মুনাফিক ছিলো না, তখনকার ইহুদীরা কি আজকের ইহুদীদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো শত্রুতা করার ব্যাপারে? তাহলে তখন ইসলামের জয় হয়েছিলো, এখন কেন হচ্ছে না? কারণটা এই আয়াতে লুকিয়ে আছে- ওরা ওদের কাজ করে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্ত আমরা বসে আছি, করছি অপেক্ষা!
আচ্ছা তাহলে কি ইমাম মাহদীর আগমনে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এই ব্যাপারটি পুরাই বোগাস? এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা কী জানতে পারি আসলে?

সেটার উত্তর জানবো আগামী পর্বে ইনশাল্লাহ।

পর্ব ৪



জাতি হিসেবে আমরা মুসলিমরা এই যে একজন ইমাম মাহদীর জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছি এটা কিন্তু একটা Attitude এর ব্যাপার যেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে আমাদের ব্যক্তি জীবনেও। অনেক সময়েই আমরা আমাদের জীবনে মিরাক্যলের অপেক্ষায় বসে থাকি কিংবা একটা Right Time এর যখন আমরা দ্বীন শিক্ষা করবো বা দ্বীনের খেদমত করবো। বিশেষ করে অনেক বোনদের আমি দেখি যে একজন প্রিন্স চার্মের জন্য অপেক্ষা করছে যে তাকে ঘরের রাণী করে রাখবে বা দ্বীন শিক্ষার অর্থায়ন করে আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বানাবে। বাচ্চার অপেক্ষায় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দিন গুনতে থাকা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তবে নিজের জীবন দিয়ে আমি একটা ব্যাপার গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে There is nothing called a perfect opportunity. এই দুনিয়ার জীবনে পরীক্ষা থাকবেই, কাজ যদি কিছু করতে হয় তবে এর মাঝেই করতে হবে। কতটুকু করবো, কিভাবে করবো এটা ব্যক্তিবিশেষে আলাদা হবে কারণ একেক জনের পরিস্থিতি একেক রকম। দিনের শেষে আমাদের টার্গেট হওয়া উচিৎ একটাই-আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে যেন বলতে পারি যে আমি আমার পরিস্থিতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।
এই ‘অপেক্ষা করার”মানসিকতা নিয়ে তো অনেক কথাই হল, মনে হবে যে আমি যেন একেবারেই এই কন্সেপ্টের পক্ষপাতী না। আচ্ছা তাহলে কি ইমাম মাহদীর আগমনে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এই ব্যাপারটি পুরাই বোগাস? এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা কী জানতে পারি আসলে? বর্তমান সিরিজে যে বুকলেটটা অনুবাদ করছি সেখানে এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ইমাম মাহদীর ব্যাপারে আমরা কুরআন থেকে কিছু জানতে পারি না। তবে এ ব্যাপারে সম্ভবত ১০০ টির বেশি হাদিস রয়েছে। তবে সেগুলোর কিছু অতিরঞ্জিত, কিছু দুর্বল আর বাকীগুলো ভাল। কিছু হাদিস হয়ত আছে যেগুলোকে বিশুদ্ধ বলা যেতে পারে, কিন্তু তা সংখ্যায় অতি নগন্য।

এই জায়গায় আমি একটা পয়েন্ট যোগ করতে চাই। একটা হাদীস কিভাবে শুদ্ধ বা দুর্বল হয় কিংবা হাদীস শাস্ত্রের একদম ব্যাসিক এমনকি হাদীসের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আমাদের অজ্ঞতা মারাত্মক এলার্মিং লেভেলে। তবে এখন বাংলায় এ সংক্রান্ত বেশ ভালো কিছু রিসোর্স বের হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। সিয়ান পাব্লিকেশন থেকে ডঃ বিলাল ফিলিপ্সের ’হাদীস বোঝার মূলনীতি বইটা অনূদিত হয়েছে ’ ।তবে এটা একদম একাডেমিক লেভেলের বই)। Jamaal Zarabozo র লেখা The authority and Importance of Sunnah (ইন্টারনেটে ফ্রিতে পাওয়া যায়) এব্যাপারে অসাধারণ একটা বই। এটার অনুসরণে মুঃ এনামুল হকের লেখা বই হচ্ছে ‘ সুন্নাতের কর্তৃত্ব ও আইনগত মর্যাদা’। আর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের হাদীসের নামে জালিয়াতি, বিদআতের বিসর্জন- সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন, এই বইগুলো একদম সাধারণ পাঠকদের উপযোগী করে লেখা আলহামদুলিল্লাহ। এব্যাপারে জ্ঞান মজবুত থাকলে আমরা অনেক বক্তার ইমাম মাহদী বা যে কোনো টপিকেই বক্তব্যে যদি কোনো ভ্রান্তি থাকে সেটা চিহ্নিত করতে পারবো ইনশাল্লাহ।

ফিরে আসছি শাইখ সালমানের বুকলেটের বিষয়বস্তুতে। সেখানে ইমাম মাহদী সংক্রান্ত একাধিক হাদীসের বিশুদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করেছেন। যেমন-

আলী ইবনে আবু তালিব হতে বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে যেখানে রাসুল (সঃ) বলেছেন, “মাহদী আমাদের আহলে বাইত থেকে হবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে একরাতে খিলাফতের যোগ্য করবেন।“[মুসনাদ আহমাদ (৬৪৫) এবং সুনানে ইবনে মাজাহ (৪০৮৫)] কিছু ইসলামিক স্কলার একে ভাল (হাসান) হাদিসের কাতারে ফেলেছেন, কিন্তু এই হাদিসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন দুর্বল বর্ণ্নাকারী রয়েছেন, (যার বর্ণনাকৃত হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে) যেহেতু এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইয়াসির বিন শায়াব আল ইজলির মত ব্যক্তি রয়েছেন যিনি আল বুখারী এর মতে বিশ্বাসের অযোগ্য এবং তার নিকট হতে প্রাপ্ত বর্ণনা অননুমোদনীয়।

এখন এই ধরণের আলোচনাগুলো যেহেতু সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য না, তাই আমি আর বিস্তারিত বর্ণনা করছি না। তবে একটা বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত- মাহদীর কন্সেপ্টটা মুসলিম ইতিহাসে একাধিকবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে হাতিয়ার ছিলো মাহদী সংক্রান্ত দুর্বল হাদীস। যেমনঃ

সাওবান হতে প্রাপ্ত একটি হাদীস হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

তুমি যদি কালো পতাকা খোরাসানের দিক থেকে আসতে দেখো তাহলে তাদের কাছে যাও, হামাগুড়ি দিয়ে হলেও, কারণ তাদের মাঝে রয়েছে আল্লাহর খলীফা মাহদী’ [ মুসনাদ আহমাদ ২২৩৮৭, মুসতাদরাক আল-হাকিম (৮৫৭২)]

এখন এই হাদিসের বর্ণনাকারীদের প্রত্যেকেই দুর্বল বর্ণনাকারী এবং অবিশুদ্ধ যদিও কিছু মানুষ এই হাদিসটির ব্যাপারে অত্যন্ত সহনশীল এবং এই হাদীসের কিছু বর্ণনার রেওয়াতকে এরা বিশুদ্ধ বলে দাবী করে। এখন কিছু মানুষ এই হাদিসটিকে ব্যাবহার করে তাদের এই মতবাদকে সমর্থন করার জন্য যে, মাহদি হবে আব্বাসীয় বংশোদ্ভুত। আবার আব্বাসীয় রাজ্যের পতাকা ছিল কালো রঙের, আর আল-মাহদী নামক একজন আব্বাসীয় খালিফা ছিলেন। সব মিলিয়ে এই দুর্বল হাদিসকে অতিরঞ্জিত করে আব্বাসীয় বংশের সমর্থনে মোক্ষমরূপে ব্যবহার করা হয়েছে।
তাহলে ইমাম মাহদীর ব্যাপারে হাদীস থেকে আমরা কী জানতে পারি? সক্ষেপে বলতে গেলে, অতিরঞ্জিত, দুর্বল এবং ভাল মিলিয়ে মাহদী সম্পর্কে অনেক হাদিস পাওয়া যায়। বিশুদ্ধ হাদিসের সংখ্যা খুব কম। অনেকগুলো হাদিস আছে যেগুলো একসাথে করলে একটি সামগ্রিক অর্থ পাওয়া যায় যদিও তাদের প্রতিটিকে আলাদাভাবে বিবেচনা করলে বিশুদ্ধতার মানদন্ডের মধ্যে পড়ে না। তাই সকল তথ্য প্রমান একত্রিত করে নেতৃস্থানীয় আলেমগণ স্বীকার করেন যে মাহদী আগমনের বিষয়টি একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস।



পর্ব ৫


গত পর্বে আমরা বলেছি যে মাহদী সংক্রান্ত সবগুলো হাদীস একসাথে করলে একটা সামগ্রিক অর্থ পাওয়া যায়। সেটা কী? সেটা হচ্ছে একেবারে শেষ যামানায় রাসুলে (সঃ) এর বংশ থেকে একজন মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবে আবির্ভূত হবেন, যিনি অন্য যে কোনো সাধারণ মানুষের মত জন্মগ্রহন করবেন। সাধারণ মানুষের মতই জীবন যাপন করবেন। এমনকি অন্য আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মত তিনিও ভুল করবেন এবং অন্য মানুষ দ্বারা তার সংশোধনের প্রয়োজন হবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা তার হাতে মুসলমানদের ধার্মিকতা, ন্যায়বিচার, সদগুণ সহ বিপুল কল্যাণ নির্ধারণ করবেন। আল্লাহ তাকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের একত্রিত করবেন। এটাই মাহদী সংক্রান্ত আহলুস সুন্নাহর বিশ্বাস।

এখানে কয়েকটা বিষয় লক্ষণীয়ঃ
১) মাহদীর জন্য প্রতীক্ষা করা সওয়াবের কাজ এমন কোনো রেফারেন্স আমরা কোথাও পাই না।
২) ইসলামী শরীয়াহর কোন দিকই মাহদীর আগমনের উপর নির্ভরশীল নয়। জুমার নামাজ, জামাতে নামাজ, জিহাদ, নির্ধারিত শাস্তি কার্যকর করা বা ইসলামের আইন প্রয়োগের মতো কাজগুলো তার উপস্থিতির উপর নির্ভরযোগ্য বলে দাবি করা ভিত্তিহীন।

তাহলে মাহদী আসার আগ পর্যন্ত একজন মুসলিমের জীবনাচরণ কেমন হবে? সে স্বাভাবিকভাবে তার জীবন পরিচালনা করবে। ইবাদাত করবে, ইসলাম সম্পর্কে নিজে শিখবে, অপরকে শিখাবে, সমাজ সংস্কার করবে, প্রয়োজন হলে জিহাদে জড়িত হবে ইত্যাদি।

যখন মাহদী উপস্থিত হবেন এবং তার পরিচয় দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আমাদের উচিত হবে তাঁর অনুসরণ করা।

এখানে লক্ষ্য করুন যে পরিচয়ের ব্যাপারে আমাদের সন্দিহান হতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে কেউ যদি নিজেকে ইমাম মাহদী হিসেবে দাবী করে আমাদের করণীয় কী হবে?

একজন মুসলিমের উচিত কোন বিষয় গবেষণা করা, যাচাই করা এবং সাবধানতার সাথে অগ্রসর হওয়া। একজন মুসলিম কখনো তাড়াহুড়া করবে না এবং ব্যক্তিগত অভিপ্রায় এবং নিজের মনোবাসনার উপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না।

এই বৈশিষ্ট্যটা কি আমাদের মধ্যে আছে? বিশেষ করে আজকের লাইক, শেয়ার আর কমেন্টের যুগে? আমরা কি একটা হুজুগে মেতে ওঠা জাতিতে পরিণত হই নি?

আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবী করাটা একটা পরিচিত ঘটনা ,ইতিহাসে যেটার বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শাইখ সালমান একাধিক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন, আমি শুধু একটার কথাই বলবো।
মুহাম্মাদ অথবা আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ নামে সুদানে এক মাহদী ছিলেন যিনি মাহদীর আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এখনো সে দেশে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিদ্যমান। তিনি বলতেন যে, তিনি রাসুল (সঃ) এর পরিবারবর্গীয় (আহলে বাইত), তিনি এটাও দাবি করতেন যে তিনি ওহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি এও দাবী করতেন যে, মুহাম্মাদ (সঃ) স্বয়ং তার সাথে কথা বলতেন এবং তিনি তাকে বলেছেন যে, সে-ই মাহদী। অনেক লোক তার সাথে সমবেত হয়েছে। স্বীকার করা হয় যে এই আন্দোলন থেকে ভাল কিছু বেরিয়ে এসেছিল, কারণ এই আন্দোলন সুদানকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে ভূমিকা রাখে।

আচ্ছা আমরা কি কেউ জানি যে শিয়া মতবাদে মাহদী সংক্রান্ত বিশ্বাসের স্বরূপ কেমন?

প্রশ্ন উঠতে পারে যে এটা জেনে আমাদের কী লাভ/ আমাদের কেন জানা দরকার। আমরা আসলে সামনের পর্বগুলোতে ‘মাহদীর জন্য অপেক্ষা করা’- এই মানসিকতার একটা মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করবো, তখন মাহদীর ব্যাপারে শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস জানাটা আমাদের বেশ কিছু বিষয় বুঝতে সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ।

পর্ব ৬

শিয়া মতবাদ অনুযায়ী মাহদীঃ

শিয়া মতবাদে মাহদীর উপর বিশ্বাস করা ঈমানের একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। তাদের আক্বীদা এর উপরে স্থাপিত। শিয়াদের অসংখ্য উপদল রয়েছে যাদের বিভিন্ন ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে কিন্তু তারা সবাই এই ‘অপ্রকাশিত ইমাম’ সম্পর্কে ঐক্যমত পোষণ করে। তারা তাকে “ইমাম মাহদী” হিসেবে অভিহিত করে যদিও কে এই মাহদি এ ব্যপারে তারা ভিন্ন মত পোষণ করে।

কিন্তু এই ‘অপ্রকাশিত ইমামের’ ব্যাপারটা কী? এই ধারণার জনক হচ্ছে ‘আব্দুল্লাহ বিন সাবা।” যারা জাল হাদীসের ইতিহাস পড়েছেন, তাদের এই নামটা মনে থাকার কথা। এই ইহুদী বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলোই ইসলামকে ভেতর থেকে ধ্বংস করার জন্য। তার বক্তব্য ছিলো- “ঐ মানুষগুলো কতইনা অদ্ভূত যারা দাবি করে যে ঈসা(আঃ) ফিরে আসবেন কিন্তু এটা অবিশ্বাস করে যে মুহাম্মাদ (সঃ) ফিরে আসবেন এবং তিনিই বরং দ্বিতীয়বার ফিরে আসার জন্য ঈসা (আঃ) থেকে বেশি উপযুক্ত!”

আমরা কি কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছি যে এই ধরণের বক্তব্য প্রচারের পরিণতি কী? আমরা সবাই জানি যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই যে শেষ নবী এটা কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, এটা বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। কেউ যদি সজ্ঞানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর কোন নবী আছে বলে দাবি করে (যেমন কাদিয়ানি ও বাহী সম্প্রদায়), তাহলে তা নিঃসন্দেহে কুফরী। আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা এটা জানতো বলেই সে ঈমানের এই স্তম্বের উপর আঘাত করেছে ছিঁচকে চোরেরে ন্যায় পেছনের দরজা দিয়ে। সে এটা বলেনি যে আরেকজন নবী আসবেন, বরং তার বক্তব্য ছিলো যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই কবর থেকে ফিরে আসবেন। একবার মানুষ বা তাদের অন্তত একটি দল যখন এই ধারণাটি গ্রহন করে নিল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে থাকল, তখন বিষয়টি সহজ হয়ে গেল। যে কেউ এগিয়ে এসে দাবি করতে পারত যে সে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কবর থেকে ফিরে এসেছে।

আব্দুল্লাহ বিন সাবা এই দাবীও করেছিলো যে আলি ইবনে আবু তালিবই ছিলেন মাহদী। সে বলতো, “যদি তাঁর মস্তিষ্ককে সত্তরটি ভাগ করেও আমার কাছে নিয়ে আস, আমি বিশ্বাস করব না যে তিনি মারা গিয়েছেন।”

তার দাবি ছিলো যে আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ফিরে আসবেন এবং পৃথিবীতে সুশাসন কায়েম করবেন যেহেতু পৃথিবী অন্যায়ে ভরে গিয়েছিল। এই দাবি পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ বিন হানাফিয়্যার মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল যিনি ছিলেন আলি বিন আবু তালিবের পুত্র। তারপর ইতিহাসে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে, একেক সময় একেক ব্যক্তি নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবী করতে থাকেন। তারপর যখন তাকে দমন/ হত্যা করা হয়, তখন দেখা যায় যে অনুসারীরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কেউ তাঁর মৃত্যুকে স্বীকার করে বিশ্বাস করা শুরু করে যে মাহদী তাহলে অন্য কেউ। আরেক দল আবার দাবী করতে থাকে যাকে তারা মাহদী ভেবেছিলো তিনি মারা যাননি বরং আত্মরক্ষা করেছেন এবং পালিয়ে গেছেন, ফিরে আসবেন।

এভাবে শিয়া রীতিতে মাহদী ক্রমাগত একব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রতিবারই তারা যাকে মাহদী বলে বিশ্বাস করেছে সে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মুহাম্মাদ বিন আল-হানাফিয়্যার পরে অনেকেই মুহাম্মাদ বিন জাফরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন যিনি জাফর আল-সাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর কেউ কেউ ইসমাঈল বিন জাফরের দিকে ফিরলেন। এরা ইসমাঈলিয়্যা নামে পরিচিত যা বাতিনিয়্যার একটি উপদল। তিনি যখন অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু্ বরণ করলেন, অন্য একটি দল অপেক্ষা করতে থাকল মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈলের। এরা বায়্যিনাহর আরেকটি উপদল যারা ক্বারামিতাহ নামে পরিচিত। শিয়ার সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় হচ্ছে ‘ইসনা আশারিয়া’ (the twelvers) । তারা বার জন ইমামকে স্বীকৃতি দেয়, তার শেষ ব্যাক্তি হলেন মুহাম্মাদ বিন আল-হাসান আল-আসকারি, যাকে মাহদী বলা হয়। তাদের মতে তিনি একজন অভ্রান্ত ইমাম যিনি ১২০০ বছর পূর্বে ভূমধ্যসাগরীয় একটি গুহায় গুপ্তাবস্থায় করেছিলেন।

কিন্তু এখন কি আমরা শিয়াদের মাঝে এইরকম কোনো কিছুর কথা শুনতে পাই?

উত্তর হচ্ছে ‘না’!

সেই শিয়া, যার পুরো ইতিহাস প্রত্যাশা ও অপেক্ষার- একমাত্র শিয়া যারা কয়েক ডজন মাহদী তৈরি করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে মাহদী না আসা পর্যন্ত জুমার নামাজ, জিহাদ এবং অন্যান্য অনেকগুলি কাজ বৈধ ছিল না – এখন তারা শিক্ষা গ্রহণ করেছে এবং মহাদীর অপেক্ষায় থাকা সম্পর্কে তাদের ধারণাগুলি পরিবর্তন করেছে । তারা ধারণাটি ত্যাগ করেনি। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মাহাদির অপেক্ষায় বিশ্বাসী, তবে তারা অপেক্ষা করার বিকল্প খুঁজে পেয়েছে। তারা কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেছে এবং ফলাফল অর্জন করেছে। এই পরিবর্তনের কারণে তারা নিজেরাই জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গঠন করেছে। তাদের মিডিয়া কার্যক্রম এবং তাদের ক্রিয়াকলাপ আজ অতুলনীয়।


‘মাহদীজম’ এ এখন আক্রান্ত কারা?


আহলে সুন্নাহর তরুণ প্রজন্ম!


এখান থেকে আমরা কী বুঝি?

পর্ব ৭


আমরা নিশ্চয়ই জানি যে ইতিহাস জুড়ে শিয়ারা সবসময়ই ছিলো সংখ্যালঘু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা সাধারণত সুন্নাহ মতালম্বীদের হাতেই থাকত। ফলে তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন এবং বঞ্চিত মনে করত। তাদের নেতারা প্রভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রগুলি থেকে অনেক দূরে ছিলেন, তাই তারা তাদের এই অক্ষমতাকে প্রতিস্তাপন করার জন্য তাদের অনুগামীদের এমন ধারণা প্রদান করেন যা তাদের উদ্দীপনাকে রক্ষা করবে এবং তাদের সংকল্পকে দৃঢ় করবে।

এটি নিখুঁত মনস্তাত্ত্বিক কিছু হতে পারে (মাহদী হিসেবে দাবী করা ব্যক্তিরা নানা কল্পনা করেন যে আল্লাহ না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জানাচ্ছেন যে তারাই মাহদী) , আবার কারও কারও ইচ্ছাকৃত কাজও (রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি এবং বৈষয়িক লাভের জন্য) হতে পারে। তবে অনুসারীরা এই ধারণাগুলি নিয়ে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে তারা প্রকৃতপক্ষে এগুলিকে বিশ্বাস করা শুরু করেছিল এবং তারপরে এগুলি সত্যিকারের প্রত্যয়ের সাথে অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছিল। সুস্পষ্ট আন্তরিকতা, সততা এবং অকপটতার সাথে প্রচারিত এই ধারণাকে অন্যরা সহজেই গ্রহন করে নেয়। এটা শিয়াদের একটা পথ বের করে দিয়েছিল যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের কোন উপায় ছিল না। তারা বহু বিদ্রোহ প্ররোচিত করেছিল কিন্তু তার সবই ব্যর্থ হয়েছে। এ সকল বিদ্রোহের বর্ণনা এবং ফলাফল আল-আসকানি রচিত ‘মাক্বাতিল আল-তালিবান’ বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

কিন্তু আজকের শিয়াদের মাঝে আমরা এমন কিছু দেখি না।
অনুরূপভাবে আহলে সুন্নাহর কিছু লোক যখন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, তখন তারাও এই ধারণাগুলি পালানোর উপায় হিসাবে গ্রহণ করে। স্প্যানিশরা যখন মুসলমানদের স্পেন থেকে বিতাড়িত করেছিল, তখন কিছু মুসলমান দাবী করে মাহদী হাজির হয়েছিলেন। তারা প্রত্যাশিতভাবে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিল, বিশ্বাস করে যে তিনি যখন আসবেন, তিনি তাদের স্পেনীয়দের বিপক্ষে জয়ের পথে নিয়ে যাবেন।

তাহলে কী দেখলাম আমরা?

মাহদীজম শিয়া বা সুন্নী কোনো ব্যাপার না, বরং এটা ভীষণ হতাশা এবং ছিন্নমুল আশার মুখে আঁকড়ে ধরার একটা অবলম্বন।
কখন জাতিগতভাবে আমরা হতাশায় ভুগতে পারি? একাধিক কেস হতে পারে-
১) কোনো বড় উদ্যোগ বা আন্দোলন যখন ব্যর্থ হয়। নির্দিষ্ট কিছু বাষ্পীভূত হয়ে গেলে তাদের আশা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে, তারা নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে এবং হতাশায় ডুবে যায়। কারও আগমনের অপেক্ষা করে তারা পালানোর পথ খুঁজতে পারে।

মুসলিম জাতির জন্য সুনির্দিষ্ট যে কোনও নির্দিষ্ট উদ্যোগের উপর তার আশা বেঁধে রাখা উচিত নয়। ইসলামী কাজের ক্ষেত্রটি কেবল একটি উদ্যোগ বা অন্যটিতে সীমাবদ্ধ থাকার চেয়ে অনেক বিস্তৃত। কিছু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, অন্যগুলো সফল হবে। এইভাবে, মানুষের হৃদয় দুর্বলতা এবং হতাশা থেকে পরিষ্কার থাকতে পারে। পরাজয়, ব্যর্থতা এবং হতাশা মাহদিবাদী ধারণাগুলি প্রসারিত করার জন্য আদর্শ পরিবেশ সরবরাহ করে, বিশেষত যারা তাদের মধ্যে এমন একটি ইতিবাচক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন না যা তাদের শক্তিকে সঠিক দিকে প্রয়োগ করতে পারে।

২) যখন আমরা এই প্রত্যাশা করি যে পৃথিবীর সকল অসমতা চোখের পলকে দূর হয়ে যাবে। হ্যাঁ আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি যে আল্লাহ চাইলে এমনটা ঘটতে পারে, কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য তিনি একটি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি আমাদের সে লক্ষ্যে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাই আল্লাহ বলেনঃ
“নিশ্চই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না করে।” [ সুরা আর রা’দঃ ১১]
এই ব্যাপারটা বোঝা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার কাছে। এধরণের মানুষেরা সবচেয়ে Damaging যে কাজটা করে তা হল তারা কোনো ধারাবাহিক বা আংশিক পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দিতে পারে না। যারা নিজেদের সাধ্যমত কিছু না কিছু করে যাচ্ছে, উল্টা তাদেরকে demoralize করার জন্য নানা নেতিবাচক মন্তব্য করে। যেমন ধরুন পরিশ্রমী ব্যাক্তিদের দিকে তারা উপহাসের সাথে তাকায় এবং বলতে থাকেঃ “আপনি কি করতে পারেন বলে আপনি মনে করেন? আপনি কি আপনার ছোট্ট হাত দিয়ে প্রবল বাতাসের কিংবা জলপ্রবাহের দিক পরিবর্তন করতে পারবেন?” এরা আমূল পরিবর্তন ব্যাতীত সমাধানরুপে আর কিছুই দেখেনা আর ভাবে যে এরূপ পরিবর্তন কেবল ইমাম মাহদী বা ‘অন্য’ কোনো ব্যক্তির হাতেই আসবে।

আচ্ছা আমরা কি এই দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত? আপনি/ আমি? আয়নার দিকে একটু তাকাই তো, কী দেখতে পাই?

শেষ পর্ব


এতদিন ধরে শিয়া ও সুন্নী মতবাদে মাহদী নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগার ‘টাইমিং’ এর যে পার্থক্য আমরা দেখলাম সেটা থেকে আমরা কী বুঝলাম?
ইতিহাস জুড়ে বেশিরভাগ মাহদীস্ট দাবিগুলি উত্তেজনা ও সঙ্কটের পরিবেশে এবং সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্থানের সময়ে এসেছে। এ জাতীয় সমস্ত মাহদিস্ট আন্দোলন এমন সময়ে ঘটেছিল যখন মানুষ, বিশেষত যুবকরা আটকা পড়েছিল অন্ধকারে এবং যখন তারা কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই মাহদীর ধারণার দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারেনি।

আচ্ছা, যে কোনো কাজে যে একজন নেতার প্রয়োজন এই ব্যাপারটাতো ইসলামে একটা স্বীকৃত বিষয়, তাই না? তাহলে ইমাম মাহদীর বিষয়টাকে আমরা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছি কেন?

আসলে কোনো বৈধ বিষয়কে অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করাও এক ধরনের বিচ্যুতি। যেমন আপনি যদি শিয়াদের বইগুলো পড়েন এবং তাদের নীতিগুলি এবং বিশ্বাসগুলি বিবেচনা করেন, তখন মনে হয় পৃথিবী এবং পুরো মহাবিশ্বটি কেবলমাত্র ইমামের কার্যালয়ের জন্য তৈরি হয়েছিল, বিশেষত `আলি বিন আবু তালিব এবং তার বংশধরদের জন্য। তাদের দেখে মনে হয় যেন এই ইমামগুলিই সমস্ত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে এবং আখেরাতের জীবন তাদের কাছ থেকে এবং তাদের জন্যই উদ্ভুত হয়। যেন মানুষের একমাত্র সত্য নেতৃত্ব এবং মানবতার জন্য সংস্কারের একমাত্র উৎস তারাই। তারা তাদের ইমামদের সম্পর্কে অনেক উঁচু ধারণা পোষণ করে অথচ সেগুলোর স্বপক্ষে তাদের নিকট কোন প্রমাণ নেই।
তাহলে আমরা কি মাহদীর ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিবো? নাহ, আমরা মধ্যপন্থী উম্মাত। কিছু লোক মাহদীর সম্পর্কে হাদীসটি পুরোপুরি অস্বীকার করে। ইতিহাসের সর্বত্র মাহাদির ধারণাটির অপব্যবহার করার কারণেই প্রায়শই তারা এটি করে, যেন তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে সমস্যাটি শেষ হয়ে যায়। যদিও কখনও কখনও তাদের অস্বীকারের কারণ হলো সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব। এটা আরেক ধরনের চরমপন্থা। যারা মাহদীর আগমন নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগে আর যারা মাহদীকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, উভয়েই চরমপন্থী। এটা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই যে, একটি বিষয়কে অতিমাত্রায় গুরত্বারোপ করার অর্থ হল অপর কোন একটি বিষয়কে সমভাবে অবহেলা করা।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, ইসলাম অপেক্ষা করার একটি শক্তিশালী বিকল্প সরবরাহ করে। আবু হুরাইরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে আমরা এই সম্পর্কিত মূলনীতিটি পাওয়া যায়: “প্রত্যেক শতাব্দীর শুরুতে আল্লাহ এই জাতিকে প্রেরণ করেন যারা দ্বীনের নবায়ন করেন।” [সুনান আব দাউদ (৪২৯৯)]

নবায়নের বিষয়টি একটি বৈধ ইসলামী ধারণা এবং শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ এ নিয়ে কাজ করেছেন। আবু বকর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে জনগণকে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনেন এবং মুরতাদদের সাথে লড়াই করেন। `উমর বিন আবদুল আল-আযীজ উমাইয়াদের সংস্কারে এর সাথে জড়িত ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী, আহমদ এবং অন্যান্য আলেমরা যুগে যুগে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

এটি এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব সংস্কারে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। এটা পুনরুজ্জীবন করা, এমন কিছু নয় যার জন্য মাহদীর মতো কোনও ব্যক্তির আগমনের অপেক্ষায় থাকতে হবে; এটা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যারা দ্বীন নবায়ন করে”। এটি একটি সাধারণ বিবৃতি, কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নির্দেশক নয়। এটি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত অসংখ্য মানুষকে ঈংগিত করে। শিক্ষা, সাইক্যোলোজি, রাজনীতি, ইবাদাত, অর্থনীতি এবং মিডিয়া সহ জীবনের এতগুলি বিষয় যার অন্তর্ভুক্ত সেই ইসলামকে কে একক ভাবে নবায়ন করতে পারে? এটি কোনও একক ব্যক্তি বা এমনকি একটি গোষ্ঠী দ্বারা অর্জন করা যায় না। এইরকম সুদূরপ্রসারিত নবায়নের জন্য বিশাল সংখ্যক লোকের প্রয়োজন। কেউ শিক্ষা ক্ষেত্রে, কেউ অর্থনৈতিক সংস্কারে, কেউ ইসলামি কাজে বা কেউ ত্রাণ কাজে নিযুক্ত হবে যাদের সবার মূল উদ্দেশ্য হবে সংস্কার এবং নবায়ন।

বুকলেটটির শেষে শাইখ সালমান কিছু বিষয়ের দিকে বিশেষভাবে গুরত্ব দিয়েছেন-
১) আমাদের যুবসমাজের শোনার ধৈর্য্য বাড়াতে হবে। এটা বিশেষভাবে প্রয়োজন আমাদের নেতাদের জন্য, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক উভয় ধরনের। কারণ যখন মানুষ জানতে পারে যে তাদের কথা আমলে নেয়া হচ্ছে তখন তাদের হৃদয়ের অসন্তুষ্টি কিছুটা হলেও দূর হয়। এটি বোঝাপড়া, আলোচনা এবং বিনিময়ের পথ খুলে দেয়। এটি মুসলিম সমাজের ঐক্য এবং যুবসমাজের শক্তিকে সুরক্ষিত রাখে। যা তাদের শক্তিকে আশপাশের বাস্তব বিপদ মোকাবিলা করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দিকে পরিচালিত করে।

২) তরুণ মুসলিমদের অবশ্যই শালীন এবং সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ দিতে হবে। দরিদ্রতা এবং বেকারত্ব মানুষকে যেকোন বিপদগামী আদর্শের জ্বালানীরূপে ব্যবহার করে।

৩) মুসলিম জাতিকে বিপদগামী চিন্তা ভাবনা এবং নৈতিক স্খলন থেকে অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে।

৪) আমাদের মিডিয়া, ইন্টারনেট, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। এগুলো আজকাল ব্যবহৃত হচ্ছে ইসলামের ব্যাপারে কুৎসা রটনা এবং মুসলমানদের পবিত্র বিষয়গুলোকে অবমাননা করতে। এখন এগুলোর বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা যেন আবার ইসলামিকভাবে অনুমোদিত সীমানার বাইরে না চলে যাই। অসুস্থ ও নৈতিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা যদি অশ্লীল উপায়ে ইসলামকে ডিফেণ্ড করতে যায় তাহলে তা জন্ম দিবে হিংসাত্মক এবং অপ্রিয় প্রতিক্রিয়ার, যার ফলে আদতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা আরো প্রচার পাবে।

পরিশেষে বলতে চাই যে ,কিছু মানুষ আছে যারা চায় সব সমস্যার সমাধান তাদের জীবনকালের মধ্যেই ঘটুক। তারা বাস্তবতার সীমানার বাইরে প্রত্যাশা করে থাকে। তারা তাদের নিজেদের পরিশ্রমের ফলের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে বরং পছন্দ করে প্রতীক্ষা করা এবং স্বপ্ন দেখা এমন কিছুর জন্য যার জন্য কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে না।
আমি আকুলভাবে দুআ করি যাতে আমি, আমার পরিবার, আমার উত্তর প্রজন্ম এই ধরণের মানুষদের মত না হই।

[আমাদের ছায়া অনুবাদের এখানেই সমাপ্তি। এটা আমার একটা Long Pending কাজ ছিলো, আল্লাহ শেষ করার তৌফিক্ব দিলেন আলহামদুলিল্লাহ। আবারো বলছি আমি হুবহু অনুবাদ করিনি, মূল বক্তব্যটা অবিকৃত রেখে কিছু নিজের উপলব্ধি যোগ করেছি। এই সিরিজ পড়ে কারো যদি কোনো উপকার হয়ে থাকে তবে সেটা বোনাস ইনশাল্লাহ। কারণ সবচেয়ে বড় বেনিফিশারী আমি নিজে। এই সিরিজ অনুবাদ করার পর থেকে আমি দ্বীন নবায়নকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য দুআ করা শুরু করেছি, আল্লাহ যেন ক্ববুল করেন। আমার ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটাতে আমি বারবার এটাই দেখানোর চেষ্টা করেছি যে আল্লাহর সাহায্য কখন আসে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বনী ইসরাঈলের ৪০ বছর ধরে মরুভূমিতে নির্বাসন ও প্রথম জেরুজালেম জয়ের ঘটনার মাঝে এটার উত্তর নিহিত আছে। এই সুযোগে সবাইকে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি ) 


লেখাটি শেয়ার করতে পারেন